রেনেসাঁস বা নবজাগরণ শব্দটি সংজ্ঞায়িত করুন এবং ইউরোপীয় সমাজে রেনেসাঁ আসার কারণ ও ফলাফল কি ছিল?
রেনেসাঁস কথাটির অর্থ কী?
রেনেসাঁস বা Renaissance বলতে কী বোঝায়?
নবজাগরণ বা রেনেসাঁস কাকে বলে এবং ইউরোপীও সমাজের উপর এর প্রভাব
Define the term
‘Renaissance’ Explain its Social roots and effects and European society.
রেনেসাঁর বা নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য
ইতিহাসের ধারা প্রবাহমান। অতীতের গহ্বর থেকে জন্ম হয় বর্তমানের। আজ যা বর্তমান, আগামী দিনে তা হয় অতীত। সুতরাং ইতিহাসকে বিভিন্ন যুগে ভাগ করা বিজ্ঞানসম্মত নয়। ঐতিহাসিক ফিসার মন্তব্য করে বলেছেন যে – “কোন নির্দিষ্ট তালিকার ভিত্তিতে মধ্যযুগ হইতে আধুনিক যুগে ভাগ করা যায় না।” [Fisher History of Europe, p
– 429]। ফিশার মনে করেছেন যে, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের উত্তরণ হয় ধারাবাহিক ভাবে। যার পরিণতি দেখতে চাই রেনেসাঁস বা নবজাগরণের মধ্যে।
রেনেসাঁস কথাটির অর্থ হলো পূর্বজন্ম বা জাগৃতি বা নবজাগরণ। প্যাগান যুগে অর্থাৎ প্রাচীন গ্রিক ও রোমান যুগের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পের পুনরায় চর্চা এবং এর ফলে পশ্চিম ইউরোপে যে নতুন মানসিকতা দেখা দেয় তাকে ‘রেনেসাঁস‘ বলা হয়। গ্রিক ও রোমান যুগে জ্ঞানের জন্য জ্ঞানচর্চার যে রেওয়াজ ছিল তা লুপ্ত হয়। মধ্যযুগের গির্জার চোখে যে ধর্ম বিরোধ মনে হতো তা নিষিদ্ধ করা হয়। ঐতিহাসিক বাইকারের মতে – “The dominant not in the
middle age’s obedience to authority.” এর ফলে মধ্যযুগে জ্ঞান–বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি ব্যাহত হয়। এই যুগে মনে করা হত – “সকল কিছু জানা হয়ে গেছে। জ্ঞানের সীমা আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে ইহা পূর্ণ এবং চিরস্থায়ী হয়েছে।
গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য ও দর্শন পাঠের প্রভাবে ইউরোপে যে যুক্তিবাদী মানসিকতা গড়ে ওঠে তাকে রেনেসাঁসের মূল কথা বলা হয়। কিন্তু রেনেসাঁসের সংজ্ঞা হিসেবে এর কোনোটি যথার্থ নয়। নবজাগরণ বা নবজন্ম দুটি ধারণারই প্রেক্ষাপট হলো ৫০০ – ১৪০০ কাল পর্বকে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ বলে মনে করা হয়। কিন্তু তা ঠিক নয়, এই কালপর্ব জাতীয় রাজতন্ত্র আর সুসংহত রাষ্ট্রব্যবস্থা চাষাবাদ উৎপাদন ব্যবসা–বাণিজ্যের বিদ্ধি ও বিস্তারিত শহর নগরের আয়তন ও সংখ্যা বৃদ্ধি প্রযুক্তির উন্নতি রচিত হয়েছিল নতুন নতুন সাহিত্য। ১৫০০ শতক থেকে এই যুক্তিনিষ্ঠ সংশয়বাদী অনুসন্ধানী মানসিকতার উদ্ভব হলো রেনেসাঁসের মূল কথা। মায়ার্স নামক ঐতিহাসিক এর মতে “অবাদমুক্ত অনুসন্ধানী, আত্মবিশ্বাসী মনোবৃত্তি হল রেনেসাঁসের প্রাণ।“
ইউরোপীয় সমাজে রেনেসাঁ আসার কারণ
Social roots of Renaissance
রেনেসাঁস বা জাগৃতি ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে আরম্ভ হয় বলে অনেক পন্ডিত মনে করেন। তাদের মতে কনস্টান্টিনোপলের পতন ঘটলে গ্রিক ও রোমান সাহিত্যের পণ্ডিতরা তাদের পুঁথিপত্র নিয়ে ইতালিতে চলে আসে। এর ফলে ইতালিতে গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যে দর্শনের চর্চা আরম্ভ হয়। ক্লাসিক অর্থাৎ প্রাচীন সাহিত্য চর্চার মাধ্যমেই জাগ্রতি বা রেনেসাঁসের সূচনা হয়। আবার কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন রেনেসাঁস একটি আকস্মিক ঘটনা ছিল না। ইউরোপে ধারাবাহিকভাবে এর বিকাশ ঘটে। রেনেসাঁসের মূল কথা ছিল গির্জার নিয়ন্ত্রণমুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ ভোগপুরে জীবনধারা। যাতে ইতালির নগর গুলির অধিবাসীরা অভ্যস্ত ছিল না। গির্জার প্রভাবমুক্ত হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ জীবন–যাপনে অভ্যস্ত ছিল।
প্রবৃত্তি ঐতিহাসিকদের মতে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের আগেই ইউরোপে বিশেষত্ব ইতালিতে একটি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এই শিক্ষিত সম্প্রদায় ছিল রেনেসাঁসের প্রধান দূত। প্রথম ইতালিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় এবং শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেড়ে ওঠে। টমাস অ্যাকুইনাস, রোজার বেকন প্রমূখ ছিল শিক্ষিত শ্রেণীর পুরোধা। রোজার বলেন যে, “সত্য কোন নির্দিষ্ট অপরিবর্তনীয় বিষয় নহে, ইহা সময় অনুযায়ী পরিবর্তনশীল।“।
রেনেসাঁস উদ্ভবের জন্য ইতালির শহর গুলি এবং তার অভিশাষক শ্রেণীর ভূমিকা উল্লেখ যোগ্য। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন কনস্টান্টিনোপলের পতনের অনেক আগে থেকেই ইতালির জীবনদর্শনে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। এই পরিবর্তনের প্রথম ধাপ হিসেবে তাঁরা ইতালির নগরায়নের কথা উল্লেখ করেছেন। ইতালির নগর গুলির মধ্যে ফ্লোরেন্স জাগরিত বা রেনেসাঁস আন্দোলনের পীঠস্থান। এই শহরকে দ্বিতীয় এথেন্স বলা হয়। আর্থিক স্বচ্ছলতা নগরজীবনে আনে ভোগবাদের প্রেরণা। বস্তুবাদী জীবন দর্শনের কাছে প্রতিযোগিতায় পিচু হঠে যায় গির্জা প্রসারিত ধর্মভিত্তিক কঠোর জীবনের আহ্বান। মিলান নগর ছিল রেনেসাঁসের অপর প্রধান কেন্দ্র, মিলানের শাসকরাও শিল্প–সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। রোমান পোপ দশম লিও তিনিও গ্রিক, ল্যাটিন সাহিত্যচর্চা ও শিল্পকলার প্রতি অনুরাগ দেখান। “মানবতাবাদি জ্ঞান ও শিল্পের আনুকূল্য দেখাইয়া জাগ্ৰতি আন্দোলনের ক্ষেত্রে পোপ রোমকে ফ্লোরেন্স উত্তরসূরি করেন। [Thompson and Johnson – Introduction middle ages, p – 1015]
অনেক ঐতিহাসিক ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ফলে রেনেসাঁসের সূচনা হয় বলে মনে করেন। ঐতিহাসিক মায়ার্সের মতে, “ক্রুসেডের কারণ ছিল মধ্যযুগীয়, কিন্তু তার ফলাফল ছিল আধুনিক।” এই ধর্মযুদ্ধের বহু সামন্ত প্রভু, ভূমিদাস বা কৃষক যোগদান করেছিল। এরা প্রাচ্যে এসে এখানকার ভোগবাদের জীবনাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হন। গির্জার কঠোর ধর্মীয় জীবন যাপন পদ্ধতির প্রতি এরা বীতশ্রদ্ধ হয়েছিল। মধ্য দেশের জ্যোতিরবিদ্যা, রসায়ন, গণিত ইত্যাদি ধর্ম যোদ্ধাদের মনকে যুক্তিবাদী করে তোলেন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে এরা নবজীবনের দূত রূপে কাজ করেন।
রেনেসাঁস বা জাগ্ৰতি সূচনা হওয়ার ক্ষেত্রে পঞ্চদশ শতকে জার্মানির গুটেনবার্গ নামক জনৈক ব্যক্তি মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন,
মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে সাহিত্যের বাণী সহজে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পরে। কবি,
সাহিত্যিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা পুস্তক মারফত খুব সহজে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। অতঃপর অন্ধবিশ্বাস দূর হয়। জ্ঞান বিদ্যার প্রসার ঘটে।
পঞ্চদশ শতকে রেনেসাঁসের ফলে যে জাগরন ঘটে তাহার ব্যাপকতা ও গভীরতা সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে।সিমন্ডস প্রমূখ মনে করেন রেনেসাঁসের উদ্ধত সমগ্র ইউরোপীয় সমাজকে প্রভাবিত করে। উচ্চ–নিচ,
ধনী–দরিদ্র সকলেই কমবেশি রেনেসাঁসের ধর্মনিরপেক্ষতা ও যুক্তিবাদে প্রভাবিত হয়। রেনেসাঁস প্রাণবন্যা নানা রূপ দিয়েছিল। নানপথে ধাবিত হয়েছিল রেনেসাঁসের উদ্ভাস। জ্ঞান,
চিত্রকলা, শিল্পসমৃদ্ধ হয়েছিল রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে। মানবতাবাদি আন্দোলন প্রসার লাভ করেছিল এর ফলে। এটি ছিল একটি বৌদ্ধিক আন্দোলন। স্কলাস্টিক দার্শনিকরা মানবতাবাদের উদ্যোক্তা তারা ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করেছিলেন। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন নতুন আবিষ্কার ঘটতে শুরু করেছিল যা যুগ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিল।
মধ্য যুগ পেরিয়ে নবজাগরণের বুদ্ধিদীপ্ত আলো মানবতাবাদীদের চিন্তাভাবনা নিয়ে এসেছিল আধুনিক যুগের নীলাকাশ। ফলে অনেক কিছুই সম্ভব হয়েছিল যেমন– সংস্কার আন্দোলন গুলি। নতুন চিন্তা ভাবনা মানুষের মর্যাদার প্রশ্নটিকে বড় করে দেখিয়েছিলো ফলে ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ বা শাসনের নিগড় পেরিয়ে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। খ্রিস্টীয় মানবতাবাদীরা শিক্ষার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার ফলে তাঁরা খ্রিস্টীয় ধর্মের অনাচার দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করে। একাজে পোপের চার্জ বাধা দিচ্ছিল। কাজেই পোপ বিরোধিতা শুরু হয়। জাতীয় চার্চের চিন্তা ধারা আসে। শাসকরা চার্চের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি কায়েম করতে চেষ্টা করেন, চার্চের সাধারন যাজকরা এতে যোগদান করেন। ফলে ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের বশবর্তী হয়ে মানুষের মনকে যুক্তিবাদী করে তোলে।