ভারতে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের কারণ কী?
অথবা, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে চরমপন্থীদের উন্মেষের কারণ আলোচনা করো।
অথবা, ভারতের জাতীয় আন্দোলনে চরমপন্থী আন্দোলনের উৎপত্তির কারণগুলি আলোচনা করো।
What caused the rise of militant nationalism in India?
Or, discuss the reasons for the emergence of extremists in India’s freedom struggle.
Or, discuss the causes of origin of extremist movement in Indian national movement.
উত্তর
সূচনা:-
জাতীয় কংগ্রেসের প্রথমপর্বে (১৮৮৫-১৯০৫ খ্রি.) কংগ্রেস দল পরিচালনার ভার ছিল নরমপন্থী বা মডারেটদের ওপর। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় চরমপন্থী ও নরমপন্থীদের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। চরমপন্থীরা নরমপন্থীদের আবেদন-নিবেদনমূলক রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। নরমপন্থী নেতৃত্বের আদর্শ ত্যাগ করে জাতীয় কংগ্রেসের যুবশক্তি ভারতের চিরন্তন সনাতনী ধর্ম ও তার ঐতিহ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উনিশ শতকের শেষের দিকে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটায়। সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন লালা লাজপত রায়, বিপিনচন্দ্র পাল, বালগঙ্গাধর তিলক, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ।
বিভিন্ন কারণ :
ভারতীয় রাজনীতিতে এই চরমপন্থা তথা উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও প্রসারের পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল।
i.কংগ্রেসি আন্দোলনের দুর্বলতা :
কংগ্রেসের প্রথমযুগের নেতাদের আবেদন-নিবেদন নীতির প্রতি ব্রিটিশ সরকারের ঔদাসীন্য কংগ্রেসের তরুণ সদস্যদের অসহিষ্ণু করে তোলে। শেষ পর্যন্ত তারা এই ‘রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। অরবিন্দ ঘোষ ‘ইন্দুপ্রকাশ’ পত্রিকায় অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে লেখেন যে, কংগ্রেসের গঠনতন্ত্র, লক্ষ্য ও কর্মপদ্ধতি ভ্রান্ত ও অবৈধ। তিলক স্বরাজের দাবি জানিয়ে বলেন— ‘Swaraj is my birth right and I must have it’।
ii. ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ:
ইংরেজের সীমাহীন শোষণ, বৈষম্যমূলক করবিন্যাস, দেশীয় শিল্পের ধ্বংসপ্রাপ্তি এবং দেশবাসীর বেকারত্ব ভারতবাসীকে নিদারুণ অর্থসংকটের মুখোমুখি দাঁড় করায়। দাদাভাই নওরোজি, রমেশচন্দ্র দত্ত, মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে প্রমুখ নরমপন্থী নেতা তাঁদের বিভিন্ন মূল্যবান ও তথ্যসমৃদ্ধ রচনায় ব্রিটিশ শোষণের এই নগ্নরূপটি সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরেন। উইলিয়াম ডিগবি-ও তাঁর ‘Prosperous British India’ গ্রন্থে ভারতের এই অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য সরাসরি ব্রিটিশ শোষণকেই দায়ী করেন। দাদাভাই নওরোজি তাঁর ‘Poverty and Un British Rule in India’ গ্রন্থে লেখেন—‘Self-Government is the only remedy for India’s woes and wrongs’ ।
iii. সনাতন ধর্ম, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রভাব :
রাজনারায়ণ বসুর উদ্যোগ ও হিন্দুমেলার কার্যকলাপ; বঙ্কিমচন্দ্রের সর্বত্যাগী হওয়ার আহ্বান ও বন্দেমাতরম্ মন্ত্র, বিবেকানন্দের স্বদেশ-প্রীতি, ক্লীবতা বর্জনের উদাত্ত আহ্বান ও শিকাগো বিশ্বধর্মমহাসভায় ভাষণ (১৮৯৩ খ্রি.); দয়ানন্দের হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার আদর্শ মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনে প্রাণোৎসর্গ করার জন্য যুবমানসে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিলক কর্তৃক মারাঠি ভাষায় গীতার অনুবাদ, লাজপত রায় কর্তৃক উর্দু ভাষায় শ্রীকৃষ্ণের জীবনী রচনা, অরবিন্দ ঘোষ কর্তৃক বাংলা ভাষায় গীতার নিষ্কাম কর্মের সরল ব্যাখ্যা যুবসমাজকে চরমপন্থায় অনুপ্রেরণা জোগায়। স্বামী বিবেকানন্দের উদাত্ত আহ্বান ছিল—“ওঠো, জাগো। কারণ তোমাদের মাতৃভূমি মহাবলি প্রার্থনা করিতেছেন”।
iv. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষে সরকারি উদাসীনতা:
ক্ষরা, দুর্ভিক্ষ, প্লেগ, মন্বন্তরে মানুষ যখন না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে তখনও ব্রিটিশ কোনোরকম সাহায্য না করে, নিজ স্বার্থ রক্ষায় মশগুল ছিল। মার্কসবাদী ঐতিহাসিক রজনী পামদত্তের মতে— ১৮৫১ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মোট ২৪টি দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। এইসব দুর্ভিক্ষের অধিকাংশের জন্যেই ব্রিটিশ দায়ী ছিল। উইলিয়াম ডিগবির মতে—ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে দুর্ভিক্ষে মোট ২ কোটি ৮০ লক্ষ ২৫ হাজার ভারতীয় প্রাণ হারায়। ব্রিটিশের এই দায়িত্বহীনতার সমুচিত জবাব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকেই চরমপন্থী বা সংগ্রামশীল মানসিকতার উদ্ভব ঘটে।
-
অনাচার ও নৈরাজ্যমূলক ভূমিকা:
বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ব্যাপক প্লেগ দেখা দিলে তা দমনের নামে সরকারি অত্যাচার মানুষকে স্তম্ভিত করে দেয়। আক্রান্ত জনগণের চিকিৎসা ও রোগ-প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা না করে ত্রাণকাজের ওই অর্থ মহারানি ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনারোহণের হীরকজয়ন্তী উৎসবে ব্যয় করা হয়। সরকারের এই অনাচার ও নৈরাজ্যমূলক ভূমিকা জনমানসে প্রবল ঘৃণা ও ক্ষোভের সঞ্চার করে।
vi. বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রভাব:
সমকালীন বেশ কিছু সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করেছিল। অরবিন্দের ‘বন্দেমাতরম্’, বিপিনচন্দ্র পালের ‘নিউ ইন্ডিয়া’, শিশিরকুমার ঘোষের ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’, মাদ্রাজের ‘দি হিন্দ’, লাহোরের ‘দি ট্রিবিউন’ প্রভৃতিতে ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করা হয়, যা উগ্র সংগ্রামী মানসিকতার জন্ম দেয়।
vii. আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির প্রভাব:
সে সময়ের কিছু আন্তর্জাতিক ঘটনা ভারতে চরমপন্থী মতবাদের উদ্ভব ও বিকাশে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল। ইতালি-আবিসিনিয়ার যুদ্ধে ইতালির পরাজয় (১৮৯৪ খ্রি.) ও বুয়র যুদ্ধে ব্রিটেনের পরাজয় (১৮৯৬ খ্রি.) এবং রুশ-জাপান যুদ্ধে (১৯০৪-০৫ খ্রি.) জাপানের অসাধারণ সাফল্য ইউরোপীয়দের শ্রেষ্ঠত্বের অলীক মহিমাকে ক্ষুণ্ণ করে। তার ওপর আয়ার্ল্যান্ড, রাশিয়া ও মিশরের বৈপ্লবিক সংগ্রাম এবং তুরস্ক ও চিনে সাধারণ মানুষের জয়যাত্রা ইত্যাদি সংবাদে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা যথেষ্ট উদ্দীপিত হন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের প্রতি দুর্ব্যবহার ও ভারতের ব্রিটিশ সরকারের এ ব্যাপারে উদাসীনতা ভারতবাসীকে ব্রিটিশের প্রতি ক্ষুদ্ধ করে। সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের ভিত যে নড়ানো যেতে পারে—এ আশা ভারতবাসীর মধ্যে জাগে।
viii. কার্জনের স্বৈরাচারিতা ও বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত :
লর্ড কার্জনের ভারতবিদ্বেষ নীতি, ভারতীয়দের প্রতি ঘৃণার মনোভাব সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপট রচনা করে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে লর্ড কার্জন কোনোদিনই শিক্ষিত ভারতীয়দের যোগ্য মর্যাদা দেননি। তার ওপর ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসন ও শিক্ষার অধিকার খর্ব করতে তিনি কলকাতা কর্পোরেশন আইন (১৮৯৯ খ্রি.) ও ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন (১৯০৪ খ্রি.) পাস করতেও কুণ্ঠিত হননি। এইভাবে তাঁর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষের আগুন তো জ্বলছিলই, এবার বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা তাতে ঘৃতাহুতির কাজ করে। এইভাবে বঙ্গভঙ্গই ভারতে চরমপন্থা তথা উ জাতীয়তাবাদ উন্মেষের প্রত্যক্ষ কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে – অদুরদর্শী কার্জন বোঝেননি যে কী মারাত্মক অস্ত্র এর দ্বারা তিনি চরমপন্থীদের হাতে তুলে দিলেন।
উপসংহার :
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী নেতাদের অনেকেই সনাতনী হিন্দুধর্ম ও তার ঐতিহ্যের ওপর নির্ভর করে সংগ্রামশীল আদর্শের ভিত্তি রচনা করায় তা অনেকটাই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল, কিন্তু তাঁদের মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি কখনোই সংকীর্ণ বা সাম্প্রদায়িক ছিল না। সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ফলেই পরবর্তীকালে স্বাধীনতার প্রশ্নে গান্ধিবাদী আন্দোলনগুলিকে গণমুখী হতে দেখা যায়। এফ. রবিনসন, জে. গ্যালাহার, ডেভিড ওয়াশরুক, অনিল শীল প্রমুখ কেমব্রিজ ঐতিহাসিকগণ চরমপন্থার উৎসরূপে কংগ্রেসের ভিতরের ও বাইরের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে নির্দেশ করেছেন। ড. অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে— ঊনবিংশ শতাব্দীর ভাবজাগতিক পরিবর্তন ও রাজনৈতিক প্রয়োজনবোধ থেকেই সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে।
তথ্যসুত্রঃ-
১) আধুনিক ভারতের ইতিহাস – বিপান চন্দ্র
২) পলাশী থেকে পার্টিশন – শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়
৩) স্বদেশ সভ্যতা ও বিশ্ব – জীবন মুখোপাধ্যায়
৪) স্বদেশ পরিচয় – জীবন মুখোপাধ্যায়
৫) ইতিহাস শিক্ষক – হাজরা ও দত্ত
৬) স্বদেশ ও বিশ্ব – শান্তনু মিস্ত্রী