ফ্যাসিবাদ: বহুরূপে সম্মুখে তোমার | ফ্যাসিবাদ [fascism] | फ़ैसिस्टवाद

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now

ফ্যাসিবাদ: বহুরূপে সম্মুখে তোমার

অশ্রু কুমার সিকদার

ফ্যাসিবাদ কাকে বলে ? ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে Animal Farm এবং Nineteen Eighty four নামক গ্রন্থটির লেখক জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন কথাটার আর কোন তাৎপর্য অবশিষ্ট নেই – ‘The world Fascism is almost entirely meaningless’। কথাটা নিতান্ত গালিগালাজে পর্যবসিত হয়েছে। অন্য একজন বিশেষজ্ঞ মনে করেন ফ্যাসিজমের সংজ্ঞা নিতান্ত ‘nebulons’। মুসোলিনির নেতৃত্বে ১৯২২ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত শ্রীবৃদ্ধি পাওয়া এই ভয়ংকর তত্ত্ব ও তার প্রয়োগের বীভৎসতা আমরা দেখেছি ফ্র্যাংকোর স্পেনে, সালাজারের পোর্তুগালে, ত্রিশের দশকের চল্লিশের দশকের জাপানে। এই মতবাদের এবং এই মতবাদ অনুপ্রাণিত ক্রিয়াকলাপের চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখেছিলাম হিংস্র নাৎসিবাদে।

‘Who controls the past, controls the future’ 

একনায়ক ফ্যাসিস্ট নেতারা নিজেদের যেন, হোগেলের ভাষায় ‘World-historical men the Heroes of an epoch’ মনে করে। নৈতিকতা তাদের কাছে অবান্তর। ডস্টয়েভস্কির রাসকলনিকভ দুই বুড়িকে হত্যা করে প্রমাণ করতে চেয়েছিল সে পুতুপুতু করে আইন মেনে চলা সাধারণ মানুষ নয়, সে এমন একজন অসাধারণ মানুষ যে ‘Was a man who had the right as well as the darig, to transgress.’ সে নিজের হাতে রক্তাক্ত করে প্রমাণ করতে চেয়েছিল সে সীজার বা নেপোলিয়নের স্তরের মানুষ, যার পক্ষে সাধারণ নৈতিকতার সূত্রাবলী একেবারেই প্রযোজ্য নয়। এই বলে দুঃখ করেছিল চ্যাপলিনের মঁসিয়ে ভের্দু, অগণিত হত্যা করেনি বলেই সে ইতিহাসের নায়ক হতে পারল না, তাকে প্রাণদন্ড ভোগ করতে হলো। সে ‘transgress’ করতে পারেনি। ‘World historical men’ হওয়ার বাবদে সীজার বা নেপোলিয়ন, হিটলার বা স্টালিনের মতো নায়কেরা, transgress করার অধিকার পেয়েছেন বলে মনে করেন। একনায়কতন্ত্রী ফ্যাসিবাদে নেতার বাক্যই বেদবাক্য, নেতার নির্দেশ দলের এবং রাষ্ট্রের চরম সিদ্ধান্ত। এই তন্ত্রের কোন আইনসংগত বা নৈতিক লক্ষ্য নেই। ফ্যাসিবাদী দল এক গণতন্ত্রহীন একশিলা ব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। সমরবাদী এই তত্ত্ব সাম্রাজ্যবাদীও বটে, কারণ তার লক্ষ্য সাম্রাজ্যবিস্তার এবং সেই সাম্রাজ্যে স্বকীয় তত্ত্বের প্রয়োগ। জাতিবাদ, পুরুষতান্ত্রিকতা, শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি ঘৃণা এই মতবাদের বৈশিষ্ট্য। জাতি ও রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদের কাছে সমার্থক। অসহিষ্ণুতা এক মতবাদের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য, দমন ও রক্তক্ষয়ী হিংসা এই মতবাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের উপায়। যুক্তিবিরোধী বর্বর এই মতবাদ আলোকপ্রাপ্তির সমস্ত আদর্শকে ঘৃণা করে। এই চূড়ান্ত সমরবাদী জাতীয়তাবাদ নির্বাচন ভিত্তিক গণতন্ত্র, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উদারতার দুর্মর শত্রু। মানবাধিকারকে এই তত্ত্বের অনুগামী উপহাসের সামগ্রী মনে করে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের উদারনৈতিক মতবাদ বা রাজনৈতিক বহুত্ববাদকে ঘৃণা করে এই মতের অনুগামীরা। বুদ্ধিজীবীর প্রতি অবজ্ঞা, শিল্প ও শিল্পীর প্রতি উদ্ধত অবজ্ঞা ফ্যাসিবাদী তত্ত্বের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এক বানিয়ে তোলা পবিত্র নিষ্কলুষ অতীতে ফিরে যাওয়ার ডাক দেয় ফ্যাসিবাদ। কারণ ‘Who controls the past, controls the future’ বর্তমানকাল নষ্টভ্রষ্ট, সুতরাং ফিরে যেতে হবে এক অপাপবিদ্ধ অতীতে। বর্তমান কাল ভ্রষ্টনষ্ট হওয়ার জন্য দায়ি এক গোষ্ঠীকে খুঁজে বের করা হয় – কখনো ইহুদিরা, কখনো ভিন্নজাতের বা ভিন্ন ধর্মের মানুষ, কখনো বাইরে থেকে আসা মানুষ। তাদের উপর চালানো হয় সীমাহীন উৎপীড়ন। সেই উৎপীড়ন কতোদূর যেতে পারে তার পরিচয় পাই নাৎসি আমলের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। সমস্ত গণমাধ্যমকে দখল করে প্রচারের মাধ্যমে, সর্বব্যাপী আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে ফ্যাসিবাদীরা সমাজজীবনের সমস্ত স্তরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। লক্ষ্য অর্জনের জন্য, এক উৎপীড়নভিত্তিক বর্বর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ফ্যাসিবাদ গণউন্মাদনা বা পপুলিজমের আশ্রয় নেয়। কৃত্রিমভাবে প্রচারের সাহায্যে এই গণ উন্মাদনা তৈরি করা হয় এবং নিজেদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য কাজে লাগানো হয়।

প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইয়োরোপে রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে জন্ম নিয়েছিল কম্যুনিজম ও ফ্যাসিজম। কম্যুনিস্টদের নেতৃত্বে সর্বহারার বিপ্লবকে প্রতিহত করতে ধনবাদী ব্যবস্থা জন্ম দিয়েছিল এই হিংস্র ফ্যাসিবাদের। সশস্ত্র সংঘবদ্ধ লুম্পেন প্রোলেটারিয়েটকে দিয়ে চূর্ণ করতে হবে শ্রমিকশ্রেণির উত্থানের প্রয়াসকে। এই ছিল ফ্যাসিবাদের আদি লক্ষ্য। এই মতবাদ তীব্রভাবে মার্কসিজম বিরোধী। সেখানে, জার্মানিতে, ইতালিতে হাজার হাজার কম্যুনিস্ট ফ্যাসিবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ফ্যাসিজিমের বহু লক্ষণই কম্যুস্টি দলগুলি, বিশেষ করে স্টালিনপন্থী কম্যুনিস্ট দলগুলি নিজের করে নিয়েছে। ট্রটস্কিকে নির্বাসিত করে, পরে হত্যা করে, জিনোভিয়েভ-কামেনেভ-বুখারিনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিদের চক্রান্তের মাধ্যমে, মস্কোবিচারের প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে, জীবন থেকে অপসারিত করে স্টালিন বলশেভিক শাসনের নামে এক ফ্যাসিস্টরাজ কায়েম করেন। মোটামুটি ১৯৩০ সাল থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত স্টালিন সোভিয়েট দেশে যে একনায়কত্বের কালবেলা প্রতিষ্ঠিত করেন তার সানুগ্রহ বিবরণ মিলবে রয় মেডভেডেন্ডের ‘Let History Judge’ এবং রবার্ট কাকোয়েস্টের “The Great Terror” গ্রন্থে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে, টলস্টয়ের আদলে যিনি নিজেকে সাহিত্যিক প্রোফেট হিসেবে তুলে ধরেছিলেন, সেই সোলারনিচাসন লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত The Gulag Archipelago নামের মহাগ্রন্থ। ওই সময়ে লক্ষ লক্ষ কৃষককে সাইবেরিয়ার অনশিবিরে নির্বাসিত করা হয়েছিল, হত্যা করা হয়েছিল।

কম্যুনিস্ট ও একনায়কপন্থী, প্রোলেটারিয়েটের একনায়কত্বের নামে এই পার্টিতেও প্রতিষ্ঠিত হয় নেতৃত্বের একাধিপতা, নেতার একাধিপত্য – স্টালিনের, মাও-এর কাস্ত্রোর। স্ট্যালিনবাদী রাষ্ট্র ও প্রচারমাধ্যমকে দখল করে, সন্ত্রাসের মাধ্যমে জীবনের সমস্ত পর্যায়কে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনে। মানবাধিকারকে অবজ্ঞা করা, বুদ্ধিজীবিদের উপেক্ষা করা ফ্যাসিবাদীদের মতো স্টালিনবাদী দলেরও বৈশিষ্ট্য। রুশ বিপ্লবের ফলে সোভিয়েট দেশে সাহিত্য চিত্রকলা সংগীত সিনেমার ক্ষেত্রে এক আশ্চর্য সৃজনশীলতার উৎসব দেখা দিয়েছিল। কিন্তু স্টালিন পর্বের একনায়কতন্ত্রে ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসে সব সৃজনশীলতা স্তব্ধ হয়ে যায়, নির্বাসন আর মৃত্যু হয় শিল্পীদের নিয়তি। রাজনৈতিক বহুত্ববাদকে স্টালিনপন্থী কম্যুনিস্ট পার্টিগুলি গ্রাহ্য করে। না, ক্ষমতায় এলে প্রথম কাজই হয় অন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলকে ভেঙে দেওয়া, তাদের দপ্তর গুটিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়। হিটলার- মুসোলিনির আক্রমণকারী বাহিনীর হাত থেকে লালফৌজ পূর্ব ইয়োরোপের দেশগুলিকে উদ্ধার করে। ইয়োরোপের সেইসব দেশে অন্তবর্তীকালে যুক্তফ্রন্টের শাসন চালু হলেও শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাস নিপীড়নের মাধ্যমে চালু হয় ফ্যাসিস্ট স্ট্যালিনপন্থী ব্যবস্থা। চেকোশ্লোভাকিয়া রাষ্ট্রের জনক টমাস মাসারিকের পুত্র জান মাসারিককে স্নানের টবে বালিশচাপা নিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় অন্য বহু ভিন্নমতাবলম্বী জননেতাকে। এই পদ্ধতিতে ওয়ারস প্যাক্টের বন্ধনে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয় পূর্ব ইয়োরোপীয় দেশগুলিকে সোভিয়েতরাষ্ট্রের অধীনে। সেই স্টালিনবাদী ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে অবশেষে, ভেঙে পরে বার্লিন প্রাচীর। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে গণতন্ত্রহীনতায় ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যাওয়া বাইরের সেই মহাবলী সোভিয়েটরাষ্ট্র এবং ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি পায় পূর্ব ইয়োরোপের দেশগুলি। কাম্বোডিয়ায় পল পটের সন্ত্রাসী ফ্যাসিবাদী উৎপীড়নে গণহত্যায় জমে উঠেছিল। কঙ্কালের পাহাড়। মাও জেদং “শতফুল বিকশিত হোক” এই গণতান্ত্রিক স্লোগানের অন্তরালে চালু করেছিলেন এক ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের পরিমণ্ডল সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দিনগুলিতে রাতগুলিতে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে সন্ত্রাসের ব্যবহার করে যেমন ফ্যাসিবাদীরা তেমনি কম্যুনিস্টরা। যেমন ফ্যাসিবাদীরা, তেমনি কম্যুনিস্টরা-মত পার্থক্যকে, পায় ভরা ভিন্নমতকে সহ্য করতে পারে না। উমবের্তো ইকো বলেছিলেন, “Disagreement is treason” এই সূত্রটি যেমন ফ্যাসিস্টরা মেনে নেয়, তেমনি কম্যুনিস্টরা স্টালিনবাদীরা শিরোধার্য করে। তাই ভিন্ন মত পোষণকারী চুটস্কি, বুখারিন, ইমরে নাজ, লিন পিআও সবাই বিশ্বাসঘাতক। অরওয়েলের Animal Farm এর ক্ষমতাবানেরা যেহেতু চতুষ্পদ, সেই কারণে তাদের সংবিধানে লেখা হয়, “Whatever goes upon two legs is an enemy.”

আর এক ভয়ংকর ভয়ের কারণ ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ, মৌলতন্ত্রী ফ্যাসিবাদ। রাশিয়ার প্রভাবের বিরোধিতা কবে, মার্কিন সহায়তায়, আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল কট্টর ইসলামি মৌলবাদী তালিবানপন্থীরা। যে সব দেশে মুসলমানেরাই একচ্ছত্র ভাবে বসবাস করে সেইসব দেশে ইসলামি ফ্যাসিবাদ জারি করার উদ্যোগ চলে। আলজিরিয়া, তুরস্কের মতো দেশেও, আমাদের প্রতিবেশী পাকিস্তান এবং বাংলাদেশেও নানা গোষ্ঠী, নানা রাজনৈতিক দল ইসলামি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক এক সময় সন্দেহ হয় গণতান্ত্রিকতার সঙ্গে ইসলামের কোন গূঢ় বিরোধ আছে। ভারতে মুসলমান সম্প্রদায় সংখ্যালঘু বলে এখানে ইসলামি ফ্যাসিতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কাশ্মিরে, যেখানে তারা সংখ্যাগুরু সেখানে জঙ্গিগোষ্ঠী গণউন্মাদনাকে ব্যবহার করে ধর্মীয় ফ্যাসিতন্ত্র স্থাপন করতে চায়। আর এদেশের মুসলমান সমাজের মানসিকতা, আচরণ ও রাজনীতির উপরেও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে এদের নিরন্তর উদ্যোগ খেয়াল না করে পারি না। মুসলিম। অধ্যুষিত এলাকায় হাজার হাজার সস্তা অডিও ক্যাসেটের মাধ্যমে কট্টর মোল্লাদের উত্তেজক বক্তৃতার প্রচার হয়, আর কেন্দ্রিক ইসলামের যুদ্ধজয়ের বিশুদ্ধ দিনগুলিতে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান থাকে সেইসব বক্তৃতায়। ভারতবর্ষে বড়ো বিপদ হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, বিশ্বহিন্দু পরিষদ ও ভারতীয় জনতা পার্টির ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপ। ফ্যাসিবাদীদের মতো এই সংঘপরিবারের অনুগামীরা এক অপাপবিদ্ধ অতীত দিনগুলির কথা স্মরণ করিয়ে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করতে চায় – রামরাজ্য, অযোধ্যা, বজরঙ্গবলী, রাণাপ্রতাপ, ছত্রপতি শিবাজীর কথা প্রবীন তোগাড়িয়া, সাধ্বী ঋতম্ভরার উত্তেজক বক্তৃতায় উঠে আসে। এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের চোখে মুসলমান মাত্রেই সন্ত্রাসবাদী দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক। মুসলমানেরা বহুবিবাহের মাধ্যমে গোপনে গোপনে ভারতের জনবিন্যাস পরিবর্তনে বদ্ধপরিকর। মুসলমানরা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত আর সন্ত্রাসবাদী মাত্রেই মুসলমান। তারা ভারতীয়তার প্রতি অনুগত নয়। বিজেপির ভারতীয়তা অবশ্য হিন্দু ভারতীয়তা। সুধীর কাকর তাঁর The Colours of violence গ্রন্থে ঠিকই বলেছেন, নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত হিন্দুসমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য সব সময় ‘মুসলিম প্রশ্নটি সামনে রাখা এই দলের পক্ষে জরুরি। হিন্দুসমাজকে হিন্দুত্বের ছাতার তলায় ঐক্যবদ্ধ করবার জন্য, এবং হিন্দুদের মধ্যে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ছড়িয়ে দেবার জন্য মুসলমান-বিরোধিতা তাদের খুবই দরকার। এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টরা খ্রিষ্টানধর্ম প্রচারের অভিযোগে সমস্তান গ্রাহাম স্টেইনকে পুড়িয়ে মারে, সম্প্রতি কন্ধমালে খ্রিস্টানদের আক্রমণ করে, হত্যা করে, হিন্দু দেবদেবীকে অপমান করা হয়েছে বলে শিল্পী হুসেনের ছবি নষ্ট করে, তাকে নির্বাসিত জীবনযাপনে বাধ্য করে। তারা মীরাটে, ভাগলপুরে দাঙ্গা বাধায়, বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে। এই হিন্দুত্ববাদীরা মুম্বাই বিস্ফোরণ পরবর্তী সময়ে এবং গোধরা পরবর্তী সময়ে গুজরাটে সমগ্র মুসলমান সমাজকে নিশানা করে ভয়ংকর দাঙ্গা বাধায়। খাকি শর্টস্ পরা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ আর বিজেপির ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত নমুনা আমরা পেয়েছিলাম নবেন্দ্র মোদীর প্রশ্রয়ে – উৎসাহে গুজরাটের দাঙ্গায়। পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার এই মূঢ় অহমিকা দেশবাসীর মনে জাগাতে চেয়েছেন, ফ্যাসিবাদ যার নিশ্চিত পরিণাম। ধর্মনিরপেক্ষতার নীরবতায়, ধর্মনিরপেক্ষদের স্ববিরোধে বাড়বাড়ন্ত হয় ধর্মীয় মৌলবাদের, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে যদি একবার নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় বিজেপি বসতে পারে তাহলে এই দল ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত করবে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শাসন। অ-হিন্দুরা সেই ভারতবর্ষে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে ভাবে থাকবে, সেখানে ভিন্নমত পোষণের অধিকার থাকবে না, থাকবে না গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদ।

গণতান্ত্রিকতার, ধর্মনিরপেক্ষতার বড়াই করে কংগ্রেস, কিন্তু বেসামাল হলে এই দলও দাঁতেনখে হিংস্র ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠে। আইনি রায়ে ক্ষমতা হারানোর সম্ভাবনা দেখা দিতেই ইন্দিরা গান্ধি জারি করেন জরুরি অবস্থার তথাকথিত অনুশাসনপর্ব। এই অল্পকালীন লজ্জাহীন ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থায় সব ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত হয়। নেত্রীর হাতে। প্রচারের মাধ্যমে, আতংক সৃষ্টি করে একজন উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয় এবং মুহুর্মুহু উচ্চরিত হতে থাকে কোটি কণ্ঠে নেত্রীর জয়ধ্বনি। রাষ্ট্রক্ষমতা সামরিক বাহিনী ও পুলিশ দিয়ে স্তব্ধ করে দিয়েছিল প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে, মানবাধিকারকে। বিবেকী মানুষের স্থান হয়েছিল জেলখানায়। নকশালপন্থীদের দমনের অজুহাতে সিদ্ধার্থশংকর রায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে জারি হয়েছিল ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা – পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল যা খুশি করবার অবাধ ক্ষমতা। জবাবদিহির কোন প্রশ্ন নেই। এনকাউন্টারের নামে খুন করা যেতে পারে, বন্দী পালাচ্ছিল এই মিথ্যে অজুহাতে খুন করা যেতে পারে, বাড়ি থেকে তুলে এনে সারিবদ্ধভাবে খুন করা যেতে পারে, জেলে পিটিয়ে খুন করা যেতে পারে। এইসব দুষ্কর্মে পুলিশের সহায়তায় রাস্তায় নেমেছিল যুব কংগ্রেসের যুবারা, সমাজের উচ্ছিষ্ট লুম্পেন বাহিনী, একেবারে নাৎসি এস.এস. বাহিনীর মতো। লুম্পেনবাহিনীকে টাকা দিয়ে প্ররোচিত করা হয়েছিল, মদ খাইয়ে মাতাল করা হয়েছিল, অস্ত্র হাতে তুলে দিয়ে রক্তপাতের নেশায় পাগল করা হয়েছিল। সমাজবদলের স্বপ্ন দেখা কিশোর যুবকেরা ভুল ভাবে মনে করেছিল। বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস আর তাদের এই বিভ্রমের সুযোগে বিপরীত বন্দুকের নল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জন্মাদবাহিনী সরকারি মদতে।

নকশালপন্থীদের মধ্যেও আমরা পেয়েছি ফ্যাসিস্ট পরমত- অসহিষ্ণু হিংস্রতা। যাদের শ্রেণিশত্রু মনে করা হয়েছে তাদের অস্ত্রের সাহায্যে খতম করা হয়েছে। শেণিশত্রুর রক্তে হাত না বাড়ালে বিপ্লবী হওয়া যায় না, এমন ফরমান জারি করা হয়েছিল। দাবি করা হয়েছিল নেতার প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য। সামান্যতম মতাদর্শগত প্রশ্নে বহুধা বিভক্ত হয়ে যাওয়া সত্তর দশকের মুক্তিকর্মীদের মধ্যেও আমরা দেখেছি অন্তহীন আক্রমণ প্রতি আক্রমণ। মত পার্থক্য সহা করা হয়নি, মতপার্থক্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা বলে। যে আমার মতের সঙ্গে শতকরা একশো ভাগ একমত নয়, সেই আমার শত্রু। ভিন্ন মতাবলম্বীকে চিহ্নিত করা হয়েছে পুলিশের চর বলে। নকশালপন্থীদের বিষয়ে একজন প্রাক্তন নকশালপন্থীর বক্তব্য উদ্ধারযোগ্য। ইনি বলেছেন, ‘নকশালপন্থীদের আমি অন্য দলের কর্মীদের অপেক্ষা অনেক বেশি অসহিষ্ণু এবং পরমতবিদ্বেষী বলে মনে করি।…. মত ও পথের ঐক্য না হলে অস্ত্রের সাহায্যে নিষ্পত্তিকে আমার এক ধরনের মৌলবাদই মনে হয় এখন। সেই সূত্রে জনযুদ্ধ, মাওবাদী, এল.টি.টি কিংবা লাতিন আমেরিকার গেরিলাদের সঙ্গে মুসলিম উগ্রপন্থীদের কোনো পার্থক্য করা যায় না।’ এই প্রাক্তন নকশালপন্থী হলেন কথাসাহিত্যিক অভিজিৎ সেন। নকশালপন্থীদের যারা সাম্প্রতিক উত্তরাধিকারী সেই মাওবাদীদের মধ্যে সত্যিই আমরা লক্ষ্য করি একই অগণতান্ত্রিকতা। অন্য মতের প্রতি বিরুদ্ধতা যুক্তির মধ্য দিয়ে করা হয় না, করা হয় অস্ত্রের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রের নির্যাতন নেমে এলে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ করা হয়, কিন্তু মানবাধিকার লংঘনে তিলমাত্র দ্বিধা করে না নকশালপন্থীরা বা মাওবাদীরা।

‘গান্ধারীর আবেদন’ এর দুর্যোধনের কথার প্রতিধ্বনি করে আজ পশ্চিমবঙ্গের প্রধান শাসকদল। যেন বলে, ‘আপামর জনে আমি কহাইব আজ / আমিই গম্বুজ চূড়া আমি দেশ আমিই সমাজ’। 

সি.পি.আই(এম)-এর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের ত্রিশ বছরের বেশি সময়ব্যাপী শাসনে পশ্চিমবঙ্গেও নানা ফ্যাসিস্ট দুর্লক্ষণ প্রত্যক্ষ করছি আমরা। সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসি সরকারের নির্মম দমনপীড়নের প্রতিক্রিয়ায় ক্ষমতায় এসেছিল সিসিআই (এম)। ক্ষমতা হাতে পেয়ে ক্ষমতার দর্পে যেন অন্ধ হয়ে গিয়েছে এই দল। মাথার মধ্যে শুধু খেলা করছে আমরা দুশো পঁয়ত্রিশ আর ওরা মাত্র তিরিশ। ভুললে চলবে না যে হিটলারও বিরোধী-বিভাজনের সুযোগে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসেছিল। ভুললে চলবে না। সোভিয়েট ইউনিয়নে বলেশেভিক পার্টি সব সময় শতকরা আটানব্বই ভাগ ভোট পেত। বর্ধমানের সাঁইবাড়ির রক্তে হাত রাঙানো শুরু হয়েছিল, ক্ষমতাদর্পের ফ্যাসিস্ট অন্ধতায় এখন এই শাসকদের হাতে অনেক রক্তের দাগ – কলকাতার চোখের আড়ালে মরিচঝাপির উদ্বাস্তুদের, কলকাতার বুকের উপর আনন্দমার্গীদের, সবশেষে নন্দীগ্রামে কৃষকদের রক্তের দাগ। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় মাত্র তিনটি রাজ্যে তারা ক্ষমতায় এসেছে, ক্ষমতার এই সীমাবদ্ধতা যদি না থাকতো তাহলে অনুমান করি চালু হয়ে যেত পূর্ণাঙ্গ একদলীয় ফ্যাসিস্ট শাসন। পূর্ব ইয়োরোপে যেমন খুচরো সহযোগী দলগুলির ভবলীলা অচিরেই সাঙ্গ হয়েছিল, এখানেও ফরোয়ার্ড ব্লক, আর.এস.পি-র অবস্থা তেমনটাই করুণ হতো। সীমাবদ্ধ ক্ষমতায় আসীন হয়েই, ভয়ের সাহায্যে এবং লোভ দেখিয়ে, এমন এক ব্যবস্থা জারি হয়েছে যার ফলে মানুষ বোবা হয়ে যাচ্ছে, প্রতিবাদের সাহস হারিয়ে ফেলছে। সন্ত্রাস যেআছে তা বলাও যাবে না – (ব্রাস যদি কেউ বলিস তাদের ঘটবে সর্বনাশ।) ‘গান্ধারীর আবেদন’ এর দুর্যোধনের কথার প্রতিধ্বনি করে আজ পশ্চিমবঙ্গের প্রধান শাসকদল। যেন বলে, ‘আপামর জনে আমি কহাইব আজ / আমিই গম্বুজ চূড়া আমি দেশ আমিই সমাজ’। পুলিশের বন্দুকের নলের জোরে ক্ষমতা দাপিয়ে বেড়ায়। পুলিশকে, রাষ্ট্রক্ষমতাকে পরিচালিত নিয়ন্ত্রিত করে দল। দলের স্বার্থ, দলের লাভ, দলীয় ক্ষমতা সম্প্রসারণের সম্ভাবনা বিচার করে সমস্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দলের যা মত তা-ই সকলের মত হতে হবে। ভয় দেখিয়ে স্বমতে আনতে হবে, অথবা লোভ দেখিয়ে। চাকরির লোভ, প্রমোশনের লোভ, পদের লোভ, ব্যবসায়িক স্বার্থপূরণের লোভ। অন্য মত পোষণ মানেই তাদের শাসিত রাজ্যের উন্নয়নে বাধা দান। ভিন্ন মতাবলম্বীর নামে নিম্নে রটাতে জিভ এতটুকু কাপে না – মহাশ্বেতা দেবী শাসকদলের কাজের প্রতিবাদ করছেন সে নাকি নোবেল প্রাইজ পাবার লোভে। দপ্তরে বসে থাকে ছোট-ছোট গোয়েবলস্ মিথ্যা প্রচারের পটুতা নিয়ে। বিস্তৃত হয়েছে সিপিআই (এম) পার্টির ক্ষমতার জাল জেলা কমিটি থেকে লোকাল কমিটির হাত ধরে, জেলা পরিষদ, পুরা প্রতিষ্ঠান, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে এই ক্ষমতার দাপটে ঠুটো জগন্নাথ হয়ে থাকে অথবা অনুগত দাস হয়ে থাকে জেলা সমাহর্তা থেকে থানাদার। পাড়ায়-পাড়ায় বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে, পুত্রবধূ-শ্বাশুড়ি-প্রতিবেশীদের দ্বন্দ্বের মীমাংসা চাপিয়ে দেন পাড়ার দলীয় দাদা। তিনি বা তাঁরাই স্থির করেন জমির বেচাকেনার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হবে, কার কাছ থেকে বাড়ি তৈরির ইটবালি কিনতে হবে। ইস্কুল কমিটির নির্বাচন, পাড়ার ক্লাবের নির্বাচন সব স্থিরীকৃত হয় দলীয়তার ভিত্তিতে। এইভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এক জনগণতান্ত্রিক ফ্যাসিজম্। ইদানিং অবশ্য ভয় ভেঙে উচ্চারিত হচ্ছে অনেক প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। নন্দীগ্রামের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এই অধিকার পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ফিরে পেয়েছে। সমস্যা হলো, প্রতিবাদী কন্ঠস্বর যাঁকে কেন্দ্র করে সংঘবদ্ধ হতে চাইছে সেই দিদিও এক নারী-নেতাজি, সংগঠনের মধ্যে তিনিই সর্বেসর্বা, তাঁর কথার উপরে কোন কথাই হতে পারে। না। তিনি ঘাড় শক্ত করে বসে থাকবেন, যুক্তি বিনিময়-ভিত্তিক গণতান্ত্রিক সংলাপে তাঁর বদ্ধমূল অনীহা। ফ্যাসিবাদীদের মতো তারও অস্ত্র পপুলিজম, গণউন্মাদনা।

জাতিসত্তার অধিকার দাবি করে যে সব সংগঠন আন্দোলন সংগ্রাম করে চলেছে তাদের কার্যকলাপেও একই ধরনের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি। মনিপুরের জঙ্গিদের আন্দোলনের মধ্যে, অসমে উলফাদের আন্দোলনের মধ্যে একই ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করি আমরা। এইসব সংগঠন যতক্ষণ ক্ষমতাসীন নয়, ততক্ষণ রাষ্ট্রের দমনমূলক আক্রমণের সময় মানবাধিকার দাবি করে, শাসকদের তরফে গণতান্ত্রিক আচরণ প্রত্যাশা করে, কিন্তু নিজেদের ক্ষেত্রে তারা না মানে মানবিক অধিকার, না মানে গণতান্ত্রিক ভিন্নমত পোষণের অধিকার। জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কোন কোন গোষ্ঠী হাতে রাইফেল তুলে নেয়, কেউ বা তথাকথিত গান্ধিগিরি পথ বেছে নেয়। একটি উদাহরণ দিই। জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্যের অধিকারের জন্য গত শতাব্দীর আশি-নব্বইয়ের দশকে দার্জিলিং-এর পাহাড়ে আন্দোলন করেছিল সুবাস ঘিসিত্তের নেতৃত্বাধীন গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট। ফ্যাসিবাদী পদ্ধতিতে পরিচালিত সেই আন্দোলনে হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। একই ফ্যাসিবাদী পদ্ধতিতে এখন দার্জিলিং-এর পাহাড়ে পরিচালিত হচ্ছে বিমল গুরুঙের গোর্খা।

জনমুক্তি মোর্চার গোর্খাল্যান্ড আদায়ের জন্য আন্দোলন। এই নামে গান্ধীবাদী, আসলে ফ্যাসিবাদী আন্দোলনে স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে সমস্ত বিরোধী কণ্ঠস্বরকে ভিন্ন মতাবলম্বী কণ্ঠস্বরকে উৎখাত করা হচ্ছে অন্য রাজনৈতিক দলের সদস্যদের। তাদের দপ্তর দখল করে নেওয়া হচ্ছে, ঘেরাও করা হচ্ছে তাদের বাড়ি দখল করে নেওয়া হচ্ছে তাদের ঘরদুয়ার। কেটে দেওয়া হচ্ছে তাদের বাড়ির বিদ্যুতের, জলের টেলিফোনের লাইন। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের বাড়িতে। সমতলে তাদের সভা করবার অধিকার কেন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে প্রশ্ন তুলে গণতান্ত্রিক অধিকারহরণের অভিযোগ করা হচ্ছে। কিন্তু দার্জিলিংর পাহাড়ি এলাকায় অন্য কোন দলের সভাসমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ঘোষিত সভাস্থর দখল করে গোর্খা লীগের সভাকে বানচাল করে দিয়েছে মোর্চার সমর্থকেরা।

প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু হলে তাঁর ছেলে অবলীলায় প্রধান মন্ত্রী হয়ে যান, আবার তার ছেলেকে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য প্রস্তুত করা হয়। রাজ্যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীদের ছেলে বউ পরিজন সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার দরুণ পদাধিকার পেয়ে যান। বিধায়ক মারা গেলে, তার শূন্যস্থান পূরণের জন্য তার বউ বা ছেলেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তাদের কিছু অর্জন করতে হয় না, সামন্ততান্ত্রিক পরিবারতন্ত্রের দৌলতে তারা তখতে বসতে পারেন

ফ্যাসিবাদী প্রবণতা আমাদের দেশে আরও প্রায় পায় শতাব্দীর পর শতাব্দীর সামন্ততান্ত্রিক ঐতিহ্যের দরুন। এই সামন্ততান্ত্রিক প্রতাপেই বিহারে রাজপুতদের কুয়ার সেনা, ভূমিহারদের রক্ষার্থি সেনা, কুমিজমিদারদের ভূমিসেনা, যাদবদের গৌরিক সেনা এই সেদিনও পুলিশ-প্রশাসনের মদতে গ্রামাঞ্চলে গরিব নিম্নবর্গের মানুষদের উপর লুটপাট, অগ্নিকার্ড, ধর্ষণ, খুনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস জারি করেছিল। বিহারের গ্রামাঞ্চলে এদের হত্যার ইতিহাস দীর্ঘ। এইসব সেনার সাহায্যেই জমিদারেরা সামন্ততান্ত্রিক প্রভুত্ব বজায় রাখে, এরাই বুথ দখল করে প্রতিপক্ষের সমর্থকদের ভোট দিতে না দিয়ে পছন্দের রাজনৈতিক দলগুলিকে নির্বাচনে জেতায়। অবশ্য সামন্ততান্ত্রিকতার প্রশ্রয়ে ফ্যাসিবাদী প্রতাপের নির্লজ্জ প্রকাশের বিরুদ্ধে এখন প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। যে সামন্ততান্ত্রিক ঐতিহ্যে ফ্যাসিবাদ এদেশে মাথা তুলতে পারে, সেই সামন্ততান্ত্রিকতার দরুণ আমাদের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের এমন রমরমা। প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু হলে তাঁর ছেলে অবলীলায় প্রধান মন্ত্রী হয়ে যান, আবার তার ছেলেকে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য প্রস্তুত করা হয়। রাজ্যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীদের ছেলে বউ পরিজন সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার দরুণ পদাধিকার পেয়ে যান। বিধায়ক মারা গেলে, তার শূন্যস্থান পূরণের জন্য তার বউ বা ছেলেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তাদের কিছু অর্জন করতে হয় না, সামন্ততান্ত্রিক পরিবারতন্ত্রের দৌলতে তারা তখতে বসতে পারেন – শেখ আবদুল্লার ছেলে ফারুক আবদুল্লা, ফারুক আবদুল্লার ছেলে ওমর আবদুল্লা। করুণানিধির ছেলে স্টালিন পিতৃবিয়োগের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। ঘটনাটা ঘটে গেলেই তিনি সিংহাসনে আরোহন করবেন। নির্বাচিত নেতারও, মন্ত্রীরাও মনে করেন তাদের নির্বাচনক্ষেত্রটি তাদের জমিদারি। দল আমৃত্যু প্রত্যেকবার তাঁদেরকেই প্রার্থী হিসেবে মনোনিত করবে এটা যেন স্বতঃসিদ্ধ। তাই মালদহ ছিল আবু বরকত গনি খান চৌধুরীর জমিদারি, হলদিয়া হয়ে ওঠে লক্ষ্মণ শেঠের জমিদারি। গনি খান মারা গেলে তাঁর বোন বিধায়ক, তাঁর ভাই সাংসদ হন। ওইসব এলাকায় এইসব নির্বাচিত জমিদারদের কথাই শেষ কথা।

যেমন সামন্ততান্ত্রিকতা, তেমনি পিতৃতান্ত্রিকতা আমাদের সমাজে রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট প্রবণতাকে প্রশ্রয় দেয়। সাহিত্য থেকে এই পিতৃতান্ত্রিক ফ্যাসিজিমের দুটি উদাহরণ দিই। নগিব মাহফুজের The Cairo Trilogy তে পড়ি আহমদ আব্দ আল্‌-জোয়াদের কথা। বন্ধুদের মধ্যে সে একজন ফূর্তিবাজ, রঙ্গরসিকতায় পটু মানুষ। গান ভালোবাসে সে – সুরাগান করে থাকে নিয়মিত। বাহিজি, সংসর্গে – তৃপ্তি পায় এই মানুষ। কিন্তু পরিবারের লোকেরা তার এই পরিচয় জানে না। পরিবারে এই আহমদ এক কঠোর একনায়ক। ছেলেমেয়েরা তো বটেই, তার স্ত্রীও তার সামনে চোখ তুলে কথা বলতে পারে না। একদিন তার স্ত্রী আমিনা বিনা অনুমতিতে ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে নিকটস্থ মসজিদে গিয়েছিল বলে সে তাকে সাময়িকভাবে তাড়িয়ে দিয়েছিল। উৎপীড়ক রাজা ফুয়াদের মৃত্যু হলে আহমদের নাতি বলে, ‘I have no love for tyrants’ – সে ইংরেজ শাসকই হোক বা স্বদেশী রাজাই হোক। এই নাতিরা আবার তাদের মায়েদের কাছ থেকে শুনেছে দাদুর বিষয়ে – ‘Amazing tales about his tyranny’ সব দেশের পরিবারের মধ্যে আহমদ আব্দ আল জোযাদের মতো ফ্যাসিস্ট পরিবার প্রধান অনেক মিলতো। পরিবারের বাবা যেন এক–একজন খুদে হিটলার।

এই রকম ফ্যাসিস্ট বাবার কথা পাব আমরা প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘মহাস্থবির জাতক’-এ। পরিবারের কর্তা মহাদেব সব সময় ছেলেদের দিকে বা স্ত্রীর দিকে ‘রোষক্ষায়িত লোচনে’ তাকায়। এগারোই মাঘ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের লোকেদের বড়দিন। মহাদেব রাত্রি তিনটেয় উঠে উপাসনা সেরে ছেলেদের তুলে দিয়েছে। তার নির্দেশ স্নান করে দেহেমনে পবিত্র হয়ে মন্দিরে যেতে হবে। শীতকাল হয়েছে তো কী হয়েছে। বাবার মুখ থেকে হুকুম নির্গত হওয়ামাত্র তিন ভাই নিরাবরণ হয়ে শীতের ভোররাত্রে “বিনাবাক্যব্যয়ে কদম্বকন্টকিত দেহে’ কলতলায় যায়। না গিয়ে তাদের উপায় নেই । তখনও যেহেতু কলে জল আসেনি, তাই রাত্রে জমিয়ে রাখা হিমঠান্ডা চৌবাচ্চার জলে সাবান মেখে পবিত্র হয় তারা। মাকে না বলে ভিখিরিকে দেবার জন্য একটি পয়সা নেবার অপরাধে বাবা ছেলেকে এমনভাবে আছাড় মারে যে তার সংজ্ঞা লুপ্ত হবার অবস্থা। চড়ের প্রচন্ডতায় চোখে সর্ষেফুল দেখতে হয়। ঘরে ঘরে মহাদেবের মতো এমন বাবা ছিলেন, যাঁদের ‘আপনি’ বলতে হতো, যাঁদের আদেশ ধর্মীয় বিধানের মতো অবশ্য পালনীয়। আমার এক বন্ধু বলে, যেদিন থেকে বাবারা ‘বাপি’ হলেন সেদিন থেকে তাঁদের মহিমা অস্তাচলে গেল। অটল গাম্ভীর্য নিয়ে এইসব ফ্যাসিজিমের প্রতিমূর্তি বাবারা সংসারে অবস্থান করতেন, সীমাবদ্ধ পরিসরে জারি থাকতো তাঁদের ‘absolute power”। তাঁদের নির্দেশ মেনে চলা, তাঁদের অনুচ্চারিত নির্দেশ অনুমান করে চলাটাই ছিল নিয়ম। বাড়ির মেয়েদের পক্ষে বাড়ির ছোটদের পক্ষে, ইস্কুলে হেডমাস্টার মশাই, বাড়িতে স্বামী দেবতা। পিতৃদেব ছিলেন একনায়ক মহানিয়ামক। তাঁদের সমস্ত সিদ্ধান্ত অনুজ্ঞা প্রশ্নাতীতভাবে পালনীয়। এই সামন্ততান্ত্রিক পিতৃতান্ত্রিক ঐতিহ্যের দরুন আমাদের দেশে সহজেই ফ্যাসিতন্ত্র প্রশ্রয় পায় ।

ক্ষমতার মধ্যে কি নিহিত থাকবেই ফ্যাসিজিমের বীজ? যে – ক্ষেত্রে যেই ক্ষমতাবান সে ক্ষেত্রে সেই ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে চায়। তাই প্রয়োজন নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ক্ষমতার নিরন্তর হস্তান্তর। ক্ষমতা মাঝে মাঝে হস্তান্তরিত না হলে একই ব্যক্তির বা একই দলের হাতে স্থিতাবস্থা পেলে, কেন্দ্রীভূত হলে, ফ্যাসিবাদের অসুখ সমাজদেহে দেখা দেবেই। মানুষের স্বাধীনতাকে, মানবিক অধিকারকে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে নাগরিক সমাজকে অতন্ত্রভাবে সতর্ক থাকতে হবে।

Reference: 

  1. সিকদার অশ্রু কুমার. (2008, September28). ফ্যাসিবাদ: বহুরূপে সম্মুখে তোমার.Natun Path Eai Samay, Sharatkalin Bisesh Songkha(28th Sep. 2008), 231–235.

Leave a Reply