কুৎসিত ডিজে সংস্কৃতি পরিহার করে স্বদেশের
উন্নত সংস্কৃতির চর্চা করুন ও বিকট শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে স্বদেশকে রক্ষা
করুন, — বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দের নিকট একটি আবেদন ।
শ্রদ্ধেয় মহাশয়,
স্বদেশের উন্নত সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও
আজ শহরে শহরে গ্রামে গ্রামে পুজো পার্বণ, উৎসব অনুষ্ঠানাদিতে বিকট শব্দ করা নিষিদ্ধ
স্থানের কুৎসিত বিদেশী ডিজে সংস্কৃতির চর্চা চালু হয়েছে । এর ফলে একদিকে যেমন আমাদের
নিজেদের দেশের গৌরবময় সংস্কৃতি ধুঁকছে, তেমনি অন্যদিকে শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, জনগণের
স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে চলেছে ।
অথচ আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে কীসের অভাব
আছে? ঢাক, ঢোল, খোল, মাদল, দুন্দুভি, ডঙ্কা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র, বিশেষতঃ তবলা বাঁয়া
তো বিশ্বসেরা ! কীসে আমাদের এত কমতি পড়ল যে আজ নিষিদ্ধ স্থানের বিদেশী ডিজে বাজনাকে
আমাদের পবিত্র পুজো অর্চনার অঙ্গ করে তুলতে হল? বিয়ে, জন্মদিন, অন্নপ্রাশন তো আছেই,
এমনকি কোথাও কোথাও শ্রাদ্ধ বাড়িতেও ডিজে বাজছে । দেশের আদিবাসী মানুষ আজ নিজেদের মাদল
সংস্কৃতি ভুলে ডিজের বিকট তালে তালে উন্মাদ হয়ে নাচছে! কী অবস্থা! একটু ভেবে দেখতে
অনুরোধ করব, একটা দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গেলে সে দেশের পরিচয় দেওয়ার মতো
কিছু থাকে কী?
১) শব্দবিজ্ঞান কী বলে? —
শব্দ বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতেও এ এক ভয়ংকর
সংস্কৃতি! সাধারণত যেখানে আমরা ৬৫ ডেসিবেলের বেশী প্রাবল্যের শব্দ সহ্য করতে পারি না,
সেখানে ডিজে কমপক্ষে ২০০ ডেসিবেলের বেশী প্রাবল্যের শব্দ তৈরি করে । এর ঢিপঢিপ, গুরগুর
ইত্যাদি বিকট আওয়াজ সারাদিন ধরে একটানা চলতেই থাকে, এমনকি অনেক জায়গায় অধিক রাতেও বন্ধ
হয় না ।
২) আইন কী বলে? —
এদিকে দেশের আইন কিন্তু একে সমর্থন করে
না । শব্দদূষণ প্রতিরোধ আইন, ২০০০ এ স্পষ্ট বলা আছে, রাত ১০ টা থেকে সকাল ৬ টা অবধি
কোন কিছুই বাজানো চলবে না । কেউ যদি অন্য সময়ে মাইক ইত্যাদি বাজায়, তাহলে সর্বাধিক
৬৫ ডেসিবেল প্রাবল্যের নীচে শব্দ করতে পারবে, তার বেশী নয় । তার জন্য অবশ্যই সরকারী
অনুমতি আবশ্যক । এই হিসেবে ডিজে বাজানো তো অবশ্যই বেআইনী কার্যকলাপের মধ্যে পড়ে । বিভিন্ন
জায়গায় সরকার ও প্রশাসন ডিজে বাজানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে । কিন্তু জনগণের সচেতনতার
অভাবে তারা এই কাজে বেশীদূর এগোতে পারছে না । ডিজেও রমরমিয়ে বেজে চলেছে ।
৩) শিশু ও গর্ভস্থ সন্তানদের কী ক্ষতি?—
ডিজে এক মারাত্মক ক্ষতিকর বাজনা । এর
বিকট হাতুড়ী পেটানোর মতো শব্দে অপরিণত শিশু মস্তিষ্ক ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । শিশুদের
স্মৃতিশক্তি কমে যায়, বুদ্ধি মোটা হয়ে যায়, মাথায় এমন আঘাত পড়ে যে শিশুরা খিটখিটে,
অমনোযোগী হয়ে পড়ে, কথা শুনতে চায় না, বড়দের মানতে চায় না । একটু বড় হলেই এরা অদ্ভুত
সব অসামাজিক আচরণ করতে থাকে । অন্যদিকে এই বিকট ডিজে বাজনার প্রভাবে গর্ভবতী মায়েদের
অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যেতে পারে, যে কোন সময় গর্ভপাত ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, পেটের
বাচ্চাটির নানা অঙ্গের বিকৃতি ঘটার সম্ভাবনা প্রচুর ।
৪) বৃদ্ধবয়সের কষ্ট কী? —
একবার বাড়ির
বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কথা ভাবুন । তাঁরা এই ডিজের দাপটে না পারেন ঘুমোতে, না পারেন বসে থাকতে,
খেতে; শরীরে অদ্ভুত চাপ পড়ে, রক্তচাপ বেড়ে যায়, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, রক্তে শর্করার
পরিমাণ বেড়ে যায়; বেঁচে থেকে মৃত্যু যন্ত্রণা অনুভব করেন তাঁরা; যে কোন সময় হার্ট অ্যাটাক
হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর, মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যেতে থাকে । আর বাড়ীতে যদি কোন অসুস্থ
মানুষ থাকেন, তাহলে এই ভয়ংকর ডিজে বাজনায় তার কী অবস্থা হতে পারে, তা একবার ভেবে দেখবেন
।
৫) শরীরের কী কী ক্ষতি হয়? —
ষষ্ঠ শ্রেণীর ভূগোল যদি একবার খোলেন,
তবে দেখতে পাবেন, সেখানে শব্দদূষণের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে স্পষ্ট কিছু কথা লেখা আছে
। সেখানে লেখা আছে যে, শব্দদূষণের ফলে শোনার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যেতে পারে । অনেকক্ষণ
ধরে জোরে বা একঘেয়ে শব্দ বিরক্তি, যন্ত্রণা, ক্লান্তি, নিয়ে আসে । যার ফলে কাজে ভুল
হয়, কাজ করতে ভালো লাগে না । এছাড়া শব্দদূষণের কারণে উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রা, হৃৎপিণ্ডের
রোগ, চোখের রোগ, পেশীর উত্তেজনা, স্নায়ুর দুর্বলতা, হজমের সমস্যা, পাকস্থলীর রোগও হতে
পারে । এখন প্রশ্ন এই যে, আমরা কি ষষ্ঠ শ্রেণীতে দেওয়া স্বাস্থ্যবিধিটুকুও মেনে চলতে
পারব না? ভবিষ্যত প্রজন্মকে কি আমরা আধপাগল, বিকলাঙ্গ করে রেখে দেব?
৬) পড়াশুনা ক্ষতি অপরিমেয়! —
সাথে সাথে এ কথাও ভাবতে অনুরোধ করি, এমনিতেই
তো আমাদের দেশে পড়াশুনার বেহাল অবস্থা; অধিকাংশ অভিভাবকই গরীব, পিছিয়ে পড়া জনজাতির
অন্তর্ভুক্ত এবং শিক্ষা সম্পর্কে চূড়ান্ত অসচেতন । এই অবস্থায় এই ডিজে বাজনা যে শিক্ষার
কতদূর ক্ষতি করছে, তা বলে শেষ করা যায় না । কোন একস্থানে ডিজে বাজলে তার চারপাশে বিরাট
এলাকায় পড়াশুনা করা বা করানোর কোন উপায় থাকে না । আগামীকাল পরীক্ষা, হয়ত পাশে কোথাও
ডিজে বাজছে, পড়ার উপায় নেই । চাকরির পরীক্ষা দেবে বেকার যুবক যুবতী, পড়াশুনা তো দূরের
কথা, রাত্রিতে ঘুম নেই, মানসিক অশান্তি প্রবল, কী পরীক্ষা দেবে সে, বলতে পারেন ? ডিজে
ও অন্যান্য ভয়াবহ শব্দদূষণ সমাজজীবনকে আজ পঙ্গু করে তুলেছে ।
তাই আমরা ডিজে বাজানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
করার দাবী তুলেছি ও অন্যান্য শব্দদূষণ বন্ধ করার আহ্বান রেখেছি । আপনারা সমাজের বিশিষ্ট
মানুষ, আপনাদের কাছে সমাজের প্রত্যাশা অনেক । আপনারা যদি পাশাপাশি মানুষজনকে একটু বলে
দেন বা বোঝান, বা আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে সচেতন করেন, তবে সমাজ একটি বিরাট ক্ষতির হাত
থেকে অবশ্যই রক্ষা পাবে । মনে রাখতে হবে, ডিজে নিষিদ্ধ হলে কারো পেশার কোন ক্ষতি হবে
না, কারণ মাইক তো বাজবেই, এছাড়া ঢাকি, বাজনার দল আরো বেশী করে কাজের সুযোগ পাবে । ফলে
এগিয়ে আসুন, শব্দদূষণ প্রতিরোধে অংশ নিন ।
নিবেদনে —
পলাশ সরকার (শিক্ষক), সুদীপ্তা সরকার
(শিক্ষিকা), আশুতোষ সরকার (শিক্ষক), বিধান উপাধ্যায় (শিক্ষক), কল্পনা সিংহ (শিক্ষিকা),
সুবোধ সূত্রধর (শিক্ষক), দেবাংশু বিশ্বাস (শিক্ষক), সাধন মণ্ডল (শিক্ষক), সাহিনূর খাতুন
(শিক্ষিকা), সুজিত খাঁ (শিক্ষক), অমিত সাহা (শিক্ষক), পীযূষ সরকার (শিক্ষক), সুবোধ
বিশ্বাস (শিক্ষক), হাফিজুদ্দিন আহমেদ (ব্যবসায়ী), রবীন্দ্রনাথ ঢালি (সমাজকর্মী), তাপস
বালা (ইঞ্জিনিয়ার), করুণাসিন্ধু সরকার, জয়ন্ত পাল, মদনমোহন বিশ্বাস, নিখিল বালা, নিরঞ্জন
মণ্ডল, নিত্যানন্দ মজুমদার, দিবস বিশ্বাস, মনীন্দ্রনাথ সরকার, শুভ্রা বর্মন, সঞ্জিত
মণ্ডল, নিবারণ সরকার, ইন্দ্রজিৎ মণ্ডল, নীতিশ বিশ্বাস, পুলিন সরকার, গোপাল সরকার ।