ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও তৎকালীন নারী সমাজ | Ishwar Chandra Vidyasagar

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now
“দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।”

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও তৎকালীন নারী সমাজ

কলমে- দেবাশীষ বিশ্বাস

সন ১৮২০,২৬ সেপ্টেম্বর ভারতবর্ষের বুকে জন্ম নিয়েছিলেন এক কিংবদন্তি বীরপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বীরসিংহ গ্রামে পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা ভগবতী দেবীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন জেদী প্রকৃতির মানুষ। কোন কাজ করার সময় যদি তিনি বাঁধার সম্মুখীন হত তাহলে সেই কাজ তিনি আরো দৃঢ় প্রতিজ্ঞর সঙ্গে  করতেন। পাঁচ বয়সে বীরসিংহ গ্রামে সনাতন বিশ্বাস নামে এক গুরুর পাঠশালায় তাকে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে তিনি বেশিদিন পাঠ করেননি, পিতা ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্রকে কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায় ভর্তি করায়। 


১৮২৮ সালে আট বছর বয়সে বীরসিংহ গ্রাম ছেড়ে তিনি কলকাতায় যান। কলকাতায় জগদ্দুর্লভের  বাড়িতেই ঈশ্বরচন্দ্র কে নিয়ে  উঠলেন ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে সবাই ঈশ্বরচন্দ্রকে প্রচন্ড স্নেহ-ভালবাসা দিতেন। বিশেষ করে রাইমনির স্নেহের কোন তুলনা ছিল না। ১৮২৯ সালের  ১লা জুন ইশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। তখন তার বয়স মাত্র নয়। কলেজে ভর্তির প্রথমাবস্থায় কিছুটা অসুবিধার সম্মুখীন হয় ইশ্বরচন্দ্র।এই সংস্কৃত কলেজের পাশেই ছিল হিন্দু কলেজ। সংস্কৃত কলেজে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ আর বৈদ্য রাই পড়ার সুযোগ পেত, আর অন্যদিকে হিন্দু কলেজে সকল জাতির সন্তানেরাই পড়তে পেত। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন খুবই কঠোর, প্রত্যেকদিন রাতে কাজ থেকে ফিরে ঈশ্বরের পড়া ধরতেন। তাই রাতে চোখ বন্ধের কোনো উপায় ছিল না তাঁর, তেলের প্রদীপের সামনে ব্যাকরন মুগ্ধবোধ মুখস্ত করেন তিনি। ঠাকুরদাস বাড়িতে ফিরে ছেলের মুখে ব্যাকরণ পাঠ শুনতেন। কোনদিন পিতা কে পরানা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে প্রচন্ড কঠোরতার সম্মুখীন হতে হতো তার। তাই ঘুম ধরলে চোখে তেল দিয়ে রাত জাগবার চেষ্টা করতেন তিনি। এমনকি রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোতেও তিনি পড়াশোনা করতেন। রাত ১২ টায় আরামানি গির্জার ঘণ্টা শুনে ঈশ্বরচন্দ্র ঘুম থেকে উঠে সারারাত পড়তেন।সংস্কৃত কলেজের ঈশ্বরচন্দ্রের প্রথম গুরু ছিলেন অধ্যাপক গঙ্গাধর তর্কবাগীশ। তর্কবাগীশের স্নেহ থেকে দরিদ্র ছাত্ররা কখনোই বঞ্চিত হতেন না, অর্থাৎ সব ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তিনি সমান চোখে দেখতেন। ব্যাকরণ শ্রেণির পড়া শেষে দু’বছর তিনি জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের কাছে সাহিত্যের শিক্ষা নেন। পন্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের কাছে সাহিত্য পড়া শেষ করে ১৮৩৫ সালে ইশ্বরচন্দ্র অলঙ্কার শ্রেণীতে ভর্তি হন।১৮৩৮ সালে সংস্কৃত কলেজে গদ্য ও পদ্য সংস্কৃত রচনায় তিনি প্রথম হন। ১৮৩৮ সালে তিনি স্মৃতি  শ্রেণীতে প্রবেশ করেন। ১২ বছর পাঁচ মাস অধ্যয়ন করার পর ২১ বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজের শেষ পরীক্ষায় তিনি সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। নানান শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ফলে ১৮৪১ সালের ১০ই ডিসেম্বর সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকরা তাকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি দেন । 

তৎকালীন নারী সমাজ

তৎকালীন সমাজে নারীরা ছিলেন লাঞ্ছিত, নির্যাতিত অর্থাৎ সমাজে তাদের কোন মান ছিল না। রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বা সহমরণ প্রথা বন্ধ করলেও, স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবাদের যে করুণ অবস্থা তার বিরুদ্ধে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এগিয়ে আসেন। সেই সময় বয়স্ক কুলীন ব্রাহ্মণ এরা একের পর এক ছোট ছোট কন্যাদের বিবাহ করতে থাকে। বিবাহের কয়েকদিন পরেই সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণেরা মারা গেলে চরম দুঃখ কষ্ট সহ করত ,সেই ছোট ছোট বিধবা কন্যারা।ঈশ্বরচন্দ্র তাদের এই দুর্দশা সহ করতে পারলেন না।ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরলেই প্রতিবেশীদের বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিতেন তারা কেমন আছে। একবার তিনি দেখলেন ছোট্ট বিধবা কন্যা প্রচন্ড কান্নাকাটি করছে। বিদ্যাসাগর জানতে পারলেন একাদশী ব্রত পালন করার জন্য তাকে খিদের জ্বালা সহ্য করতে হচ্ছে, তাই কন্যাটি প্রচন্ড কান্নাকাটি করছে। বিধবাদের জীবনের যন্ত্রনা দেখে বিদ্যাসাগরের মনের মধ্যে প্রশ্ন আছে একজন কুলীন ব্রাহ্মণ যদি এত বিবাহ করতে পারে, তবে সেই বিধবা কন্যারা কেন বিবাহ করতে পারবে না।তাই বিদ্যাসাগর নানান শাস্ত্র ঘাটতে শুরু করলেন। শাস্ত্র ঘেটে তিনি তিন ধরনের প্রথা লক্ষ্য করে, ব্রহ্মচর্য, সহমরণ, বিবাহ। এটি লক্ষ্য করার পরই তিনি বিধবা নারীদের পুনরায় বিবাহ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্রতী হন। শুরু করলেন স্বাক্ষর সংগ্রহ। মাত্র ৯৮৬ টি স্বাক্ষর তিনি সংগ্রহ করেছিলেন, অথচ তার বিরোধী করেছিলেন এর চেয়ে অধিক ব্যক্তি। বিদ্যাসাগর পণ্ডিতদের সভা ডেকে বিধবা বিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় প্রমান দেখিয়ে বলেন-“শাস্ত্রীয় প্রমাণ আমি যা জানি দেখাইয়ছি, তা মানা না মানা আপনাদের ইচ্ছে। তাছাড়া শাস্ত্রে আছে এ আমার প্রধান যুক্তি নয়। আমার আবেদন আপনাদের হৃদয়ের কাছে, বুদ্ধির কাছে।”বিদ্যাসাগর বলেছেন-“শাস্ত্রও যুগে যুগে বদলেছে। কারণ শাস্ত্রের চেয়ে মানুষ বড়।”কিন্তু ব্রাহ্মণেরা কোনমতেই এই যুক্তি মানতে রাজি নয়। বিদ্যাসাগরকে নিয়ে তারা শুরু করলেন নানা ষড়যন্ত্র, তাকে একঘরে করে দিলেন, তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ জনক ছড়া কবিতা বানানো হলো। এমনকি তাকে মেরে ফেলারও ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। কিন্তু বিদ্যাসাগর ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ প্রবন মানুষ। বহু বাধা বিপত্তি পার করে শেষ পর্যন্ত ১৮৫৬ সালে ২৬ জুলাই ‘বিধবা বিবাহ আইন’ পাশ হয়। তিনি শুধুমাত্র আইন পাশ করেই থেমে ছিলেন না নিজ উদ্দেশ্যে তিনি বহু বিবাহ দিয়েছেন। প্রথম বিধবা বিবাহ করেছিলেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং বিধবা নারী ছিলেন কালীমতি দেবী। এমনকি বিদ্যাসাগর নিজ পুত্র কেউ বিধবা কন্যা সঙ্গে বিবাহ দেন। তার নিজের উদ্যোগে তিনি বহু বিধবা বিবাহ দিয়েছেন। নানাবার তিনি প্রবঞ্চিতও হয়েছেন। নিজ উদ্যোগে বিবাহ বিবাহ দিয়ে তিনি সর্বস্বান্ত হন, তাও তিনি কোনদিনও থেমে থাকেননি। নারীদের শিক্ষা ও বাল্যবিবাহ বন্ধের উদ্দেশ্যে তিনি নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন শিক্ষাক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষক, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন -‘বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাংলা গদ্য সাহিত্যের সূচনা হলেছিল কিন্তু তিনি সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন’। শিক্ষাক্ষেত্রে  অন্যতম কীর্তি কলকাতায় মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করা। তার বিখ্যাত কয়েকটি সৃষ্টি-বর্ণপরিচয়, কথামালা, শকুন্তলা, বোধোদয়, বেতাল পঞ্চবিংশতি, সীতার বনবাস, ভ্রান্তিবিলাস ইত্যাদি।

বিদ্যাসাগর নারীদের জন্য নিজের জীবনের বাজি রেখেছেন।নারীদের জীবনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা। বর্তমান সমাজে নারীরা লাঞ্ছিত, নির্যাতিত। রাস্তাঘাটে নারীদের অপহরণ করা হচ্ছে, তাদের নির্যাতন করা। বিদ্যাসাগর কি এই সমাজ চেয়েছিল? বিদ্যাসাগরের মতো আর বিদ্যাসাগর কী জন্মাবে না? নারীরা কি সারাজীবন ভোগ্যপণ্য হিসেবে থাকবে?

[বিদ্রোঃ- আর্টিকেল ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে Historicise Link -এ প্রকাশিত হয়েছে। Historicise Link কে more proffessional and more user friendlly বানাতে পরবর্তীতে Nana Ronger Itihase-এ Migrate হয়েছে। এই পক্রিয়া চলাকালীন আমরা(Admin) কিছু সমস্যার সম্মুখীন হই, যেকারণে আর্টিকেল প্রকাশের সঠিক সময় আসেনি। এর জন্য আমরা(Admin) ক্ষমা প্রার্থী। পাশাপাশি আমরা আনন্দিত কারণ, Nana Ronger ItihaseIndia’s first and largest academic social network in history. ]

কলমে- দেবাশীষ বিশ্বাস
ঠিকানা-কামাখ্যাগুড়ি তেতুলতলা চৌপতি, উত্তর পারোকাটা, আলিপুরদুয়ার।

আপনাদের মূল্যবান লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের। যেকোনোও সময়, যেকোনও দিন। আমরা প্রকাশ করবো।

বিষয়:-

বিজ্ঞানের আবিষ্কার,চলচ্চিত্র, খেলাধুলা, সভা-সমিতি, মনীষীদের জীবন, ধর্মান্ধতা, সামাজিক সংকট, কুসংস্কার বিরোধী, পলিটিক্যাল স্ক্যাম, পলিটিক্যাল ইস্যু, পলিটিক্যাল টেরোরিজম, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এমন যেকোন বিষয়েই লেখা পাঠানো যাবে।

নির্দিষ্ট কোন শব্দ সীমা নেই।

WhatsApp করে লেখা পাঠান:- 8116447650

…. প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন আমাদের WhatsApp নম্বরে …

লেখকের অন্যান্য লেখা:-

  1. রাজা রামমোহন রায়ের জীবন সংগ্রাম: Click Here

Leave a Reply