উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজ ও আর্যসমাজ
Briefly describe the religious and social reform efforts led by Brahmo Samaj and Arya Samaj.
ব্রাহ্মসমাজ ও আর্যসমাজের নেতৃত্বে ধর্ম ও সমাজ সংস্কার প্রচেষ্টার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
উত্তর
ভূমিকাঃ
উনিশ শতকের সূচনা থেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব ভারতবাসীর চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিল। বহু চেতনাসম্পন্ন মানুষ ভারতীয় ধর্ম ও সমাজের দৈন্যদশা দেখে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তাঁরা উপলব্ধি করেন, ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের দ্বারাই সমাজের দুর্গতি ও অনগ্রসরতা দূর করা সম্ভব। এজন্য তাঁরা ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে ব্রতী হয়েছিলেন। তবে একথা বলা প্রয়োজন যে, ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে উনিশ শতকের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হলেও এর দ্বারা সৃষ্ট নয়। শিক্ষার প্রভাবে এক প্রগতিশীল মানসিকতার সৃষ্টি হয়েছিল। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে এই সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়। ব্রিটিশ উদারপন্থীদের ভাবধারায় ভারতীয়দের যে মানসিক পরিবর্তন ঘটেছিল তার প্রথম স্পষ্ট প্রভাব পড়ে ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনে।
উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্ম সমাজ
রাজা রামমোহনের ভুমিকাঃ
যে-সব মনীষী উপলব্ধি করেছিলেন যে, পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান, দর্শন, মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদকে আশ্রয় করে ভারতীয় সমাজের অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব, রামমোহন ছিলেন তাঁদের পথিকৃৎ। রামমোহনের ভূমিকা ভারতে সংস্কার আন্দোলনের অগ্রদূত ছিলেন রামমোহন। একেশ্বরবাদের ভিত্তিতে তিনি হিন্দুধর্মের সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। এজন্য ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা করেন।
দেবেন্দ্রনাথ ও কেশব চন্দ্রের নেতৃত্বঃ
১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে রামমোহনের মৃত্যুর পর ব্রাহ্ম আন্দোলনকে কোনমতে সক্রিয় রেখেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর ও তাঁর পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন। ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজে এক নবশক্তির সঞ্চার হয়েছিল। কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী। ব্রাহ্মসমাজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তত্ত্ববোধিনী‘ পত্রিকা প্রকাশ করেন। অপরদিকে কেশবচন্দ্রের অসাধারণ উদ্যম ব্রাহ্ম আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, “It was mainly due to the personality of Keshab Chandra that the Brahma Samaj gained in strength and number.” তাঁর নেতৃত্বে নবীন ব্রাহ্মরা ‘ব্রাহ্মবন্ধু‘ স্থাপন করেন। তাঁর উদ্যোগে কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘ইন্ডিয়ান মিরর‘ এবং ‘বামাবোধিনী‘। তাঁর কৃতিত্বে ব্রাহ্ম আন্দোলন সর্বভারতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়। তিনি নিজে বোম্বাই, মাদ্রাজ ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে ব্রাহ্মধর্ম ও সমাজের আদর্শ প্রচার করেন। ফলে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় ৫০টি, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে ২টি, পাঞ্জাবে ১টি ও মাদ্রাজে একটি শাখা স্থাপিত হয়। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, “কেশবচন্দ্র পরিচালিত ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনই প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন।” কেশবচন্দ্রের সাফল্যে প্রীত হয়ে দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে ‘ব্রহ্মানন্দ‘ উপাধি দেন। সেই সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক ও আচার্যরূপে তাঁকে নিযুক্ত করেন। কিন্তু কেশবচন্দ্রের অত্যন্ত প্রগতিশীল। দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য মহর্ষির সঙ্গে তাঁর বিরোধ শুরু হল। কেশবচন্দ্র উপবীত ধারণে বিশ্বাসী ছিলেন না। শুধু তাই নয়, উপবীতধারী ব্রাহ্মণ যে ব্রাহ্মাধর্ম প্রচারের যোগ্য নন একথা প্রকাশ্যে বললেন। উল্লেখ্য যে, দেবেন্দ্রনাথ উপবীত ত্যাগ করেন নি। বি. এল. গ্রোভার লিখেছেন, “তিনি সংস্কৃত শাস্ত্র অধ্যয়নের বিরোধী ছিলেন।” তিনি এবং তাঁর অনুগামীরা অসবর্ণ বিবাহ, বিধবা বিবাহ সমর্থন করায় এবং সংস্কৃতের পরিবর্তে বাংলায় মন্ত্র উচ্চারণের ব্যবস্থা করায় দেবেন্দ্রনাথ ক্ষুব্ধ হন। তিনি কেশবচন্দ্রকে আচার্যপদ থেকে চ্যুত করেন।
ভারতবর্ষও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজঃ
এর ফলে কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে স্থাপিত হয় ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ‘। দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম- সমাজ ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ‘ রূপে পরিচিত হয়। ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ‘ কতকগুলি প্রগতিমূলক সমাজ সংস্কারে নেতৃত্ব দেয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, স্ত্রীশিক্ষা, অসবর্ণ বিবাহ, নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। তিনি মদ্যপান ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। ফলে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ‘তিন আইন‘ পাশ করে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করে এবং অসবর্ণ বিবাহ আইন সিদ্ধ করে। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ কিন্তু ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ‘ ভেঙ্গে গেল কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীদের মধ্যে বিরোধকে কেন্দ্র করে। কেশবচন্দ্রের খ্রিস্টীয় ও ভক্তিবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা অনুগামীরা সমর্থন করতে পারেন নি। তার উপর যখন তিনি তাঁর নাবালিকা কন্যার সঙ্গে কুচবিহারের হিন্দু মহারাজার বিবাহ দিলেন, তাঁরা অসন্তুষ্ট হয়ে কেশবচন্দ্রকে ত্যাগ করে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ‘।
ব্রাহ্ম আন্দোলনের অবদানঃ
ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রভাব প্রায় এক শতাব্দী ধরে বাংলার শহরাঞ্চলে এবং উচ্চশিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তথাপি অস্বীকার করা যায় না যে, ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রভাবে হিন্দু সমাজ অনেক প্রগতিশীল হয়ে উঠেছিল। হিন্দু সমাজের শিক্ষিত ব্যক্তিরাও পরিবর্তনের নানা দাবি ব্রাহ্ম আন্দোলনের তোলেন। ব্রাহ্মসমাজ চেষ্টা করেছিল শাসনতান্ত্রিক উপায়ে সমাজ সংস্কার করতে। ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে সমাজে স্ত্রীজাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিভিন্ন আন্দোলনের ফলে। ব্রাহ্ম আন্দোলন খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও প্রসারকে রোধ করতে পেরেছিল। ব্রাহ্মসমাজ সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণের জন্য ব্রতী হয়েছিল। কেশবচন্দ্র সেনের ‘সঙ্গত সভা‘ তার একটা বড় দৃষ্টান্ত। ব্রাহ্ম আন্দোলন সর্বভারতীয় রূপ গ্রহণ করার ফলে পরোক্ষভাবে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। একথা বিপিনচন্দ্র পালও স্বীকার করেছেন।
উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনে আর্যসমাজ
দয়ানন্দ সরস্বতীর ভূমিকাঃ
বাংলার ব্রাহ্মসমাজের মত পাঞ্জাবে আর্যসমাজ ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রতী হয়েছিল। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী এই সমাজের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মধর্মের প্রভাবে, মিশনারীদের সঙ্গে আলোচনার ফলে এবং সমতা ও ন্যায় বৈশেষিকা সম্পর্কে তাঁর ধারণার প্রভাবে। তাঁর চিন্তায় পাশ্চাত্য অপেক্ষা ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব ছিল বেশি। তাঁর লক্ষ্য ছিল ভারতকে ধর্ম, সমাজ ও জাতীয়তার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা। তিনি বেদকে আশ্রয় করেছিলেন কারণ তাঁর মতে, বেদ অভ্রান্ত ও সমস্ত জ্ঞানের আকর। তাঁর এই বিশ্বাস তাঁকে কিছুটা রক্ষণশীল করে তুলেছিল। নীতির প্রতি তাঁর কঠোর আনুগত্য ছিল। তবে তিনি বৈদিক শিক্ষার সঙ্গে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধন করতে চেয়েছিলেন। ‘সত্যার্থ প্রকাশ‘ ও ‘বেদ ভাষা‘ নামে দুটি গ্রন্থে তিনি তাঁর ধর্মীয় মতাদর্শ প্রকাশ করেন।
সমাজসংস্কার আন্দোলনঃ
বাস্তবধর্মিতা দয়ানন্দের আর্যসমাজ আন্দোলনের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তিনি ছিলেন সমস্তরকম গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে। তাঁর মতবাদ রক্ষণশীল হিন্দুসমাজে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন নারীশিক্ষা, বিধবা বিবাহ, সমুদ্রযাত্রা ও নারী-পুরুষের সমানাধিকারের প্রবল সমর্থক। অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। হিন্দু সমাজকে শক্তিশালী করার জন্য এবং অন্য ধর্মের লোকেদের হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করার জন্য তিনি ‘শুদ্ধি আন্দোলন‘ প্রবর্তন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর আন্দোলনের ধারাকে অব্যাহত রাখেন লালা হংসরাজ, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ প্রমুখ অনুগামীরা। লালা হংসরাজ ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে দয়ানন্দ ‘অ্যাংলো-বেদিক কলেজ‘ প্রতিষ্ঠা করেন। জীবনের শেষদিকে তাঁর চেতনা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল ভারতের সামগ্রিক ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্জাগরণে। অমলেশ ত্রিপাঠী মনে করেন, “স্বামী বিবেকানন্দের মত দয়ানন্দ ও ভারতে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ গঠনে পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিলেন।”
মুল্যায়ন
উনিশ শতকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যে-সব ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল। সেগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ‘মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদ’। সংস্কারকরা ভারতীয় সমাজের পাশ্চাত্যকরণ চাননি অনুকরণের মাধ্যমে চেয়েছিলেন আধুনিকীকরণ। তাঁদের অবদানে গড়ে ওঠা প্রগতিশীল সমাজ ক্রমশ রাজনৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
তথ্যসুত্রঃ-
১) আধুনিক ভারতের ইতিহাস – বিপান চন্দ্র
২) পলাশী থেকে পার্টিশন – শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়
৩) স্বদেশ সভ্যতা ও বিশ্ব – জীবন মুখোপাধ্যায়
৪) স্বদেশ পরিচয় – জীবন মুখোপাধ্যায়
৫) ইতিহাস শিক্ষক – হাজরা ও দত্ত
৬) স্বদেশ ও বিশ্ব – শান্তনু মিস্ত্রী
Read Offline – উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজ ও আর্যসমাজ pdf
উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজ ও আর্যসমাজ TOP SHORT QUESTION AND ANSWER | Nana Ronger Itihas