প্রাচীন ভারতবর্ষের সাহিত্যিক উপাদান সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
প্রাচীন ভারতবর্ষের সাহিত্যিক উপাদান । History Notes History Notes । প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান প্রশ্ন উত্তর History Notes । Sources of Ancient Indian History
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
প্রশ্নঃ- ইতিহাসের উপাদান কাকে বলে ? প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসের উপাদানগুলিকে ক-টি ভাগে ভাগ করা যায় ?
উত্তরঃ– অতীতকালের মানুষের ব্যবহৃত সমস্ত দ্রব্য বা রচনা, যা তাদের সঠিক ইতিহাস জানতে আমাদের বিশেষভাবে সাহায্য করে, সেগুলিকে এককথায় ইতিহাসের উপাদান বলা হয়।
প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসের উপাদানগুলিকে আমরা মোট দুটি প্রধান অংশে বিভক্ত করতে পারি, যথা—
i) সাহিত্যধর্মী উপাদান এবং
ii) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান।
উত্তরঃ– ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক এশিয়াটিক সোসাইটির সেক্রেটারি জেমস প্রিন্সেপ ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার করেন। তিনি ব্রাহ্মী লিপিতে রচিত অশোকের লেখ-র পাঠোদ্ধার করেন।
উত্তরঃ– ভারত সম্পর্কে বিদেশি লিপিগুলির মধ্যে এশিয়া মাইনরের আনাতোলিয়ায় প্রাপ্ত বোঘাজ কোই লিপি, বেহিস্থান লিপি, ইরানে প্রাপ্ত পারস্য সম্রাট দরায়ুনের পারসেফালিস এবং নাকস্-ই-রুস্তম লিপি ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
উত্তরঃ– ভারতের অভ্যন্তরে মৌর্য সম্রাট অশোকের লিপিগুলিতে প্রাকৃত ভাষা ও ব্রাহ্মী লিপি বা হরফ ব্যবহৃত হয়েছে। স্থানীয় জনগণের সুবিধার জন্য কেবলমাত্র সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অশোকের লিপিগুলিতে খরোষ্ঠী লিপি ব্যবহৃত হয়েছে। আফগানিস্তানে প্রাপ্ত অশোকের শিলালিপিগুলিতে গ্রিক ও আরামিক লিপির ও ভাষার ব্যবহার দেখা যায়।
উত্তরঃ– এলাহাবাদ প্রশস্তি রচনা করেন সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণ। এলাহাবাদ প্রশস্তিতে গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্তের কীর্তিকাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
উত্তরঃ– দিল্লির কুতুবমিনারের কাছে মেহেরৌলি গ্রামে একটি লৌহস্তম্ভে উৎকীর্ণ তারিখবিহীন লিপি (মেহেরৌলি লৌহ স্তম্ভলিপি) থেকে জানা যায় যে, চন্দ্র নামে জনৈক রাজা বঙ্গের নৃপতিবর্গের এক সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং সপ্তসিন্ধু অতিক্রম করে বাহ্লীক দেশ জয় করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এই চন্দ্ররাজা গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত।
উত্তরঃ– ‘নাসিক প্রশস্তি’তে সাতবাহন বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর কীর্তিকাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর মৃত্যুর উনিশ বছর পরে বাশিষ্ঠীপুত্র পুলমায়ীর রাজত্বকালে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর মা গৌতমী বলশ্রী কর্তৃক ‘নাসিক প্রশস্তি’ উৎকীর্ণ হয়েছিল। সাতবাহন বংশের দুর্দিনে পুত্রহারা মা এখানে তাঁর পুত্রের অতীত কীর্তিকাহিনি স্মরণ ও লিপিবদ্ধ করেছেন।
উত্তরঃ– জৈন কবি রবিকীর্তি আনুমানিক ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত ভাষায় ‘আইহোল প্রশস্তি’ রচনা করেন।
এই প্রশস্তিতে বাতাপির চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশির কীর্তিকাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
উত্তরঃ– উমাপতি ধর রচিত দেওপাড়া প্রশস্তিতে বাংলার রাজা বিজয় সেনের কীর্তিকাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
আরও পড়ুন…
উত্তরঃ– নানাঘাট লেখ থেকে সাতবাহন বংশের তৃতীয় রাজা প্রথম সাতকর্ণীর রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায়। এই শিলালেখ উৎকীর্ণ করান প্রথম সাতকর্ণীর রানি নায়নিকা।
উত্তরঃ– দশপুর নগরের একটি পুরোনো সূর্যমন্দিরের সংস্কার উপলক্ষ্যে কবি বৎসভট্টি ৪৭৩ খ্রিস্টাব্দে মান্দাসোর লেখটি রচনা করেন।
উত্তরঃ– ভুবনেশ্বরের কাছে প্রাকৃত ভাষায় লেখা হাতিগুম্ফা শিলালিপি থেকে কলিঙ্গের চেদী বংশের রাজা খারবেলের কৃতিত্বের কথা জানা যায়। হাতিগুম্ফা হল একটি প্রশস্তি।
উত্তরঃ– বারাণসীর নিকটস্থ ভিতারি স্তম্ভলেখ থেকে স্কন্দগুপ্তের কীর্তিকাহিনি জানা যায়। স্কন্দগুপ্তের সিংহাসন আরোহণের বিষয়ে এই লেখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই লেখতে স্কন্দগুপ্তের হুন বিজয়ের উল্লেখ আছে।
উত্তরঃ– সিরিয়ার গ্রিক রাজা সেলুকাস মেগাস্থিনিসকে দূত হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দরবারে পাঠান। গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস একটি ভারত বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন, যার নাম ‘ইন্ডিকা’। এই গ্রন্থটি মৌর্য যুগের সমাজ ও রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
উত্তরঃ– ‘অর্থশাস্ত্র’ হল একটি রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থ। এর লেখক কৌটিল্য বা বিষ্ণুগুপ্ত। গ্রন্থখানির রচনাকাল সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে মতপার্থক্য আছে। কেউ কেউ মনে করে, গ্রন্থখানি মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষপাদে রচিত হয়েছিল। আবার কেউ কেউ গ্রন্থখানিকে খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে তৃতীয় শতকের মধ্যবর্তী সময়ের রচনা বলে মনে করেন। এমন হতে পারে, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের কোনো আদি গ্রন্থ যুগপরম্পরায় পরিবর্ধিত হয়ে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী নাগাদ আধুনিক অর্থশাস্ত্রের রূপলাভ করেছে। অর্থশাস্ত্রে মৌর্য যুগের বহুমূল্যবান তথ্য বিধৃত আছে।
উত্তরঃ– কুষাণ যুগের বৌদ্ধপণ্ডিত অশ্বঘোষ গৌতম বুদ্ধের জীবনীরূপে ‘বুদ্ধচরিত’ রচনা করেন। জীবনীগুলির মধ্যে অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’-ই বোধহয় সবচেয়ে প্রাচীন।
উত্তরঃ– খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্টের লেখা ‘হর্ষচরিত’ একখানি উল্লেখযোগ্য জীবনকথা। থানেশ্বরের পুষ্যভূতি রাজবংশ ও সেই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা হর্ষবর্ধনের জীবনকথা অবলম্বন করেই এই গদ্যকাব্যটি রচিত হয়েছে।
উত্তরঃ– দ্বাদশ শতকের প্রথম ভাগে কাশ্মীরি কবি বিলহন ‘বিক্রমাঙ্কদেবচরিত’ রচনা করেন। কল্যাণের চালুক্যরাজ ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য ত্রিভুবনমল্লের জীবন-ই এই কাব্যের উপজীব্য।
উত্তরঃ– পালরাজ মদনপালের সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দী ‘রামচরিত’ কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি দ্ব্যর্থবোধক। একদিকে যেমন এটি পালরাজ রামপালের জীবনী, অন্যদিকে তেমনি এটি রামচন্দ্রের কাহিনি। সন্ধ্যাকর নন্দী নিজেকে ‘কলিকাল-বাল্মীকি’ বলে অভিহিত করেছেন।
উত্তরঃ– ‘গৌড়বহো’ কাব্যটির রচয়িতা হলেন বাকপতিরাজ্য। এটি প্রাকৃত ভাষায় রচিত। অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে কনৌজের রাজা যশোবর্মন কর্তৃক গৌড় রাজ্য জয়ের বিষয়টি এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
উত্তরঃ– কলহন ‘রাজতরঙ্গিণী’ রচনা করেন। এই গ্রন্থখানি ১১৪৯-৫০ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়। কাশ্মীরের বিভিন্ন রাজার জীবনীর সংকলন এই গ্রন্থখানি। আগাগোড়া পদ্যে লেখা ‘রাজতরঙ্গিণী’-ই ভারতীয় সাহিত্যের প্রথম ঐতিহাসিক গ্রন্থ।
উত্তরঃ– পালি ভাষায় লেখা একখানি মূল্যবান গ্রন্থ ‘মিলিন্দপঞ্চহো’। এটি গ্রিকরাজ মিনান্দার ও ভিক্ষু নাগসেনের কথোপকথন, যার বিষয়বস্তু বৌদ্ধধর্ম।
উত্তরঃ– তামিল ভাষায় কবিদের সমাবেশকে বলে সঙ্গম। তামিল কবিরা তামিল ভাষায় যেসব গ্রন্থ রচনা করেন, সেগুলিকে কবি সমাজ স্বীকৃতি দিয়েছিল বলে এই সাহিত্যের নাম ‘সঙ্গম সাহিত্য’। ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ এই দীর্ঘ হাজার বছর ধরে সঙ্গম সাহিত্যের রচনাপর্ব চলেছিল।
উত্তরঃ– খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর তৃতীয় বা শেষপাদে কোনো এক নামগোত্রহীন গ্রিক নাবিক রচনা করেন ‘পেরিপ্লাস অব্ দি এ্যারিথ্রিয়ান সী’। এই গ্রন্থে তৎকালীন ভারতের অর্থনৈতিক চিত্রটি বিবৃত, যা সমসাময়িক অপর কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় না। এতে ভারতের বন্দর, পোতাশ্রয়, আমদানি-রপ্তানি, পণ্যদ্রব্য প্রভৃতির নিপুণ বর্ণনা আছে।
উত্তরঃ– তিব্বতের ঐতিহাসিক তারানাথ রচিত ‘ভারতে বৌদ্ধধর্মের জন্ম’ (১৬০৮ খ্রিস্টাব্দ) নামক গ্রন্থ অজাতশত্রুর সময় থেকে মগধের ইতিহাস সম্পর্কে নানা তথ্য সরবরাহ করে। এ ছাড়া সাধারণভাবে বৌদ্ধধর্মের জন্য এবং বিশেষভাবে পাল রাজাদের জন্য এই গ্রন্থটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
উত্তরঃ– চিনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে ভারতে এসেছিলেন। ভারতে তিনি ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেক ৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অবস্থান করেন। তাঁর ভারত বিষয়ক গ্রন্থের নাম ‘ফো-কুয়ো-কি’।
উত্তরঃ– হিউয়েন সাঙ হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে ভারতে এসেছিলেন। তাঁর ভারত ভ্রমণকাল হল ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর ভারত বিষয়ক গ্রন্থটির নাম ‘সি-ইউ-কি’।
উত্তরঃ– চিনা পরিব্রাজক ই-ৎ-সিং হর্ষোত্তর যুগে ভারতে এসেছিলেন। তাঁর ভারত ভ্রমণকাল হল ৬৭১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ। বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে লেখা তাঁর গ্রন্থ ভারত ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়।
উত্তরঃ– খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে এ্যারিয়ান রচনা করেন ‘আনাবাসিস’ (অর্থাৎ অভিযান)। এই গ্রন্থ থেকে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ সম্পর্কে জানা যায়। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে জাসটিনের রচনা ‘এপিটোম’ নামক গ্রন্থেও আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের বিবরণ পাওয়া যায়।
উত্তরঃ– খ্রিস্টীয় নবম শতকের আরব পর্যটক ছিলেন সুলেমান। তিনি পাল বংশের দেবপালের রাজত্বের শেষ দিকে ভারতে এসেছিলেন। ৮৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারত সম্পর্কিত একটি বিবরণী রচনা করেন। সুলেমান লিখিত এই গ্রন্থের নাম ‘সিলসিলা-উত তওয়ারিখ’।
উত্তরঃ– প্রাচীন মানুষের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, দালান-কোঠা প্রভৃতি থেকে ইতিহাসের অনেক তথ্য জানা যায়। প্রাচীন নিদর্শনের অধিকাংশই মাটির নীচে চাপা পড়ে আছে। এখন পর্যন্ত ওইগুলির সামান্য কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। যে বিজ্ঞানের সাহায্যে সুসংবদ্ধভাবে মাটির ঢিবি খনন করে আবিষ্কৃত বস্তুনিদর্শন ও ভূপৃষ্ঠে প্রাপ্ত পুরোনো বস্তুরাজি থেকে প্রাচীন মানুষের বাস্তব জীবন সম্পর্কে জানা যায়, তাকে ‘প্রত্নতত্ত্ব’ বলা হয়।