[New] রাজা রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy) । Nana Ronger Itihas। PDF [Download]

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now

 রাজা রামমোহন রায় এবং তৎকালীন নারী সমাজ

       ড.  প্রতিমা ভট্টাচার্য 

 

 

 
 

অষ্টাদশ শতাব্দি এবং উনবিংশ শতাব্দীর পূর্বার্ধ ছিল নবজাগরণের যুগ।এই সময় বাংলায় জন্মেছিলেন নানান মনীষী‌‌, সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যিক, পরম দেশভক্ত, রাজনীতিবিদ, মহান শিক্ষাবিদ। রাজা রামমোহন রায় তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি যেমন সর্বতোমুখী অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ ছিলেন তেমনি ছিলেন জ্ঞানের মূর্তিমান বিগ্রহ। আজীবন নিরলস অপরিসীম পরিশ্রমের দ্বারা দেশ সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন। রামমোহনের সব অবদান এই স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব না। তাই শুধু মাত্র সতীদাহ প্রথা নিবারণের জন্য তাঁর অবদানকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। রামমোহন জানতেন যে নারীরা শিক্ষিত না হলে সমাজের কল্যাণ হবে না, তাই তিনি নারী শিক্ষার প্রচেষ্টাও করেছিলেন।

 

১৭৭২ সালের ২২শে মে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন। এই গ্রামের খুব নামডাক ছিল। এখানে বাস করেনরায় রায়ানবংশের মানুষেরা। নবাবের কর্মচারী হিসাবে ছোটখাটো জমিদার এঁরা। রামমোহন এই বংশের ছেলে। পিতা রমাকান্ত রায়ের তিনি দ্বিতীয় পুত্র। মাতা তারিণী দেবী। রমাকান্ত রায়ও নবাবের কর্মচারী ছিলেন। অর্থে, প্রতিপত্তিতে তিনি তখন কীর্তিমান পুরুষ। রামমোহনের মা একজন তেজস্বিনী, প্রখর বুদ্ধিমতী এবং নিষ্ঠাবতী ছিলেন। রামমোহনের জীবনে মায়ের প্রভাব পড়েছিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মত শক্তি নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন। তার ছিল প্রখর বুদ্ধি। খুব কম বয়সেই আরবি, ফারসি, সংস্কৃত এবং ইংরেজি ভাষার অগাধ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে তিনি ফারসি ভাষায় একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন নাম–  তুহফাৎউলমুয়াহ্হিদিন।
চাকরির সূত্রে ইংরেজ সিভিলিয়ান এবং কর্মচারীর সংস্পর্শে এসে ইংরেজি আদব কায়দা, সুখ স্বাচ্ছন্দ, বিশ্ব রাজনীতি এবং চিন্তাধারার সঙ্গে রামমোহন পরিচিত হতে পেরেছিলেন। দেশের আইনকানুন সম্বন্ধেও তাঁর জ্ঞান হয়েছিল ভালো রকমের। তিনি আত্মসম্মান খুইয়ে কোন কাজই করতেন না। অত্যন্ত ভদ্র ছিলেন। কটুবাক্য ভদ্র ভাষাতেই বলতেন।

 

রামমোহনের ভ্রমণের নেশা ছিল। মানুষের সঙ্গ পাওয়ার জন্য ভারতের সব জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছেন। একবার তিনি তিব্বতে গেলেন। সেখানে তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। দেখলেন তিব্বতের সবলামাদের ঈশ্বর বলে পূজা করা হচ্ছে, তাঁর মন বিদ্রোহ করে উঠলো। তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র পরমব্রহ্মই হল ঈশ্বর। রামমোহন প্রতিবাদ করলেন বললেন লামারা কি করে ঈশ্বর হতে পারে। মৌচাকে ঢিল পড়ল। রামমোহনকে চারিদিক থেকে আক্রমণ করা হয়। মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেন তিব্বতের মেয়েদের দয়ায়। জীবনে তিনি ভুলতে পারেননি এই তিব্বতি মেয়েদের কথা। ভারতবর্ষের নারীদের দুর্দশার কথা যে তিনি এত ভেবেছিলেন তার কারণ ছিল তিব্বতের মেয়েরা।

 

 

রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্পে পড়েছিলাম যে মহামায়াকে রাজীব বিয়ে করতে চেয়েছিল। মহামায়ার বাবা একদিন রাজীব আর মহামায়াকে একসঙ্গে দেখে ফেলেছিলেন। তার সন্দেহ হয়েছিল। সেই জন্য সে রাতেই মহামায়াকে চেলী পরিয়ে বাবা বিয়ে দিয়ে দিলেন এমন একজন বৃদ্ধের সাথে যে কিনা পরেরদিন মারা যাবে। বিয়ের পরের দিন সেই বৃদ্ধ মারা গেলে মহামায়ার হাতপা বেঁধে তুলে দেওয়া হল বৃদ্ধের চিতায়। আগুন জ্বলে ওঠে। মহামায়া আর্তনাদ করে উঠলো। আগুনে হাতের বাঁধন পুড়ে যাওয়ায় সে  পায়ের বাঁধন খুলে চিতা থেকে বেরিয়ে আসে। মুখ ঝলসে গেছে। সুন্দরী মহামায়া একদিন সংসার থেকে মুছে গেল। এই হল সতীদাহ। কত হতভাগিনীর শেষ চিৎকার যে আগুনের শিখায় শেষ হয়ে গেছে, তার ইতিহাস অনেকের জানা আছে। যখন চিতার আগুনের যন্ত্রণায় সে নারী চিৎকার করে উঠত তখন ঢাকঢোল বাজিয়ে সে চিৎকার শুনতে দেওয়া হয়নি। হয়তো সে সময় চিতার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষ চোখের জল ফেলেতেন কিন্তু সকলেই মেনে নিয়েছিলেন নারীর এই নির্মম পরিণামকে। কারন তাদের বিশ্বাস ছিল যে স্বর্গ লাভের একমাত্র পথ হল সতী হওয়া।

 

 

রামমোহন এই নিষ্ঠুরতাকে মেনে নিতে পারলেন না। তিনি দেখলেন যে এই জঘন্য প্রথা বিরোধী মানুষ দেশে আছেন। তাঁরা প্রতিবাদও করেছেন কিন্তু ফল হয়নি। রামমোহনের নারীদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল। তিনি শাস্ত্র বিচার করে দেখেন যে শাস্ত্রে কোথাও নারীর সতী হওয়ার বিধান নেই। ১৮১৮ সালে তিনি একটি গ্রন্থ লিখলেনসহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক নিবর্তকের সম্বাদ‘, দ্বিতীয় গ্ৰন্থও এই নামেই লিখলেন ১৮১৯ সালে। ১৮২৯ সালে সহমরণ বিষয় নামে আরো একটি বই লিখলেন। রামমোহনের লেখা প্রথম বইটির সম্বন্ধেসমাচারদর্পণপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল যে–  রামমোহন প্রমান করেছেন যে শাস্ত্রে কোথাও সহমরণ বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। তাঁর শাস্ত্র বিচারের অল্পকালের মধ্যেই এদেশে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক গভর্নর জেনারেল হয়ে এলেন। বেন্টিঙ্কের সাথে রামমোহন দেখা করে তাঁকে সতীদাহর মত কু প্রথার কথা জানালেন। তিনি রামমোহনের সহযোগিতা চাইলেন যাতে এই প্রথাকে আইন করে বন্ধ করা যায়।

 

 

রামমোহন রায় সতীদাহকে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখেননি। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে নারীর অধিকার হরণের সাথে সতীদাহ যোগ রয়েছে। কারণ প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে নারীর ন্যায্য অধিকারের কথা লিখিত আছে। যেসব হিন্দু ধর্মগ্রন্থে নারীর অধিকারের কথা ঋষিরা লিখেছেন, সেই সব ঋষিদের নামও তিনি নিজের বইয়ে উল্লেখ করেছেন। যেমন–  যাজ্ঞবল্ক্য, কাত্যায়ন, ্যাস, নারদ বৃহস্পতি। এই ঋষিরা প্রত্যেকেই নিজেদের গ্রন্থে লিখেছেন যে স্ত্রী বা মা তার ছেলেদের সঙ্গে সমান ভাগ পাবে। এমনকী মনুও নিজেরদায়ভাগগ্রন্থে স্ত্রীর অধিকার কে স্বীকার করেছেন। মনুর দায়ভাগ বিধানের অর্থ হলস্বামী জীবিত অবস্থায় উইল করলে তিনি স্ত্রীকেও তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করতে পারবেন না। রামমোহন বিচার করে দেখিয়েছেন যে স্ত্রীকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্যই সতীদাহ প্রথা শুরু হয়েছে এবং সমাজে তার প্রবণতা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছিল। তিনি শাস্ত্র অধ্যায়ন করে একথাও প্রমাণ করেছিলেন যে সতীদাহ প্রথার সাথেসাথে পণপ্রথাও হিন্দু নারীর দুর্দশার বিষময় জীবনের কারণ। সুপাত্র যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায় তাই কন্যার পিতা ধার দেনা করেও মেয়ের বিয়ে দিতেন। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনও উপায় ছিল না কন্যার পিতার। বর্তমান সমাজে যদিও বা সতীদাহ প্রথা নেই কিন্তু আজও দেখা যায় শিক্ষিত অশিক্ষিত সমাজে এই পণ প্রথা চলে আসছে। আর যদি পিতা সেই পন সময় মত না দিতে পারেন তাহলে শ্বশুর বাড়িতে মেয়ে অত্যাচারিতা হয়। আজ মেয়েরা প্লেন চালাচ্ছে, চাঁদে যাচ্ছে, ডাক্তার, শিক্ষিকা, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে তাও কেন এই পণ প্রথা বন্ধ হচ্ছে না। এটা কি বর্তমান সমাজে কাম্য। নারীরা কি চিরকালই বঞ্চিতা হয়ে থাকবে?

 

 

অপরদিকে রক্ষণশীলরা যখন জানতে পারলেন যে গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক রামমোহনের সাহায্যে সতীদাহ প্রথা আইনত বন্ধ করতে চাইছেন, তখন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরসমাচারচন্দ্রিকায়এই আইনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে লেখা চলতে লাগল।বেন্টিঙ্ককে  তাঁরা আর্জি জানালেন যে তিনি যেন রামমোহনের সাথে একমত না হন এবং হিন্দুর হিন্দুত্ব নষ্ট না করেন। অন্যদিকে গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশরা রামমোহনের সমর্থনে এগিয়ে এলেন। এছাড়া রামমোহনের পাশেতাঁর শুভচিন্তক আপনজনেরা তো ছিলেনই। অবশেষে রক্ষণশীলরা হেরে গেলেন এবং রামমোহনের প্রচেষ্টা সফল হল। এই ভাবেই নারীর ভাগ্য জয়ের পথ প্রশস্ত হল।

 

 

সতীদাহ প্রথা নিবারণ আইন পাশ হয়ে গেলেও থেমে  থাকলেন না হিন্দু সমাজের রাজা মহারাজা ভাটপাড়ার পণ্ডিতেরা। এঁরা সবাই এই আইনের বিরুদ্ধে বিলেতে প্রিভি কাউন্সিলে আর্জি জানাবার জন্য সরব হয়ে উঠেছিলেন। এঁদের মধ্যে বিশেষ ছিলেন রাধাকান্ত দেব, মহারাজা গোপী কৃষ্ণ, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, হরনাথ তর্কভূষণ। ভবানীচরণ স্থাপন করেনস্বধর্মসদাচার সদ্ব্যবহারাদি রক্ষার্থধর্মসভা। এই সভার জন্মই হয়েছিল হিন্দু দের সঙ্ঘবদ্ধ করা এবং নাস্তিকদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। সম্ভবত ব্রাহ্ম সভার সদস্যদের এঁরা নাস্তিক মনে করতেন।

 

 

বিলেতে প্রিভি কাউন্সিলে এই আইনের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য অ্যাটর্নি ফ্রান্সিস বেথিকে পাঠাবে বলে ঠিক করে ফেলে ধর্মসভা। এতেও তাঁরা ক্ষান্ত হলেন না, রামমোহনকে গুন্ডা বাহিনীর দ্বারা খুন করার চেষ্টাও করেন। কিন্তু তাঁদের সে চেষ্টাও সফল হয়নি।

 

 

সতীদাহ আইনের বিরুদ্ধে স্বধর্মসভা যখন বিলেতে প্রিভি কাউন্সিলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তখন ব্রাহ্মসভাও চুপ করে না থেকে, রামমোহনকে বিলেতে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ওই সময় রামমোহনের হাতে অত টাকা ছিল না। বিলেতে পাঠাবার জন্য দ্বারকানাথ ঠাকুর পাঁচ হাজার টাকা তাঁকে দেন। তিনি সেই টাকা গ্রহণ করে ব্রহ্ম সভাকে দান করে দেন। রামমোহন নিজের টাকাতেই বিলেতে যেতে চান। এদিকে তাঁর হাতেও বেশি সময় ছিলনা। কারণ ্যাটর্নি বেথি বিলেতে রওনা হয়ে গেছেন। যখন তিনি টাকার জন্য কিছুটা চিন্তিত, হঠাৎ তখন একটা সুযোগ এসে গেল। সেসময়ের দিল্লির বাদশা দ্বিতীয় আকবর ইংল্যান্ডের রাজার কাছে তাঁর হয়ে দরবার করবার জন্য একজন দূত পাঠাবেন বলে মনস্থ করেছিলেন। তখন ভারতবর্ষে বুদ্ধিতে, সওয়ালে জবাবে, ইংরেজি বলিয়ে মানুষ একমাত্র রামমোহন ছিলেন। তাই দ্বিতীয় আকবর রামমোহনকেরাজাউপাধি দিয়ে সম্মানিত করে বিলেতে পাঠাতে চাইলেন। রামমোহন সে প্রস্তাব গ্রহণ করে নেন। কিছুদিনের মধ্যেই প্রিভি কাউন্সিলে সতীদাহ বিলের আলোচনা শুরু হবে। তিনি চিন্তা করলেন, যেভাবেই হোক রক্ষণশীলদের নারীঘাতী নিষ্ঠুরতাকে বন্ধ করতেই হবে। তাই আর দেরি করা যাবে না।

 

 

১৮৩০ সালে নভেম্বর মাসেঅ্যালিবিয়নজাহাজে চড়ে রামমোহন ইংল্যান্ডে পাড়ি দিলেন। সঙ্গে গেলেন রামরত্ন মুখোপাধ্যায়, রামমোহনের পালিত পুত্র রাজারাম, দুইজন সহকারীর রামহরি দাস আর শেখ বক্স। এদিকে ধর্মসভার প্রতিনিধি বেথির জাহাজ ডুবে গেল ঝড়ে। বেথি বেঁচে গেলেন কিন্তু সতীদাহ বিলের বিষয়ের রক্ষণশীলদের দেওয়া কাগজপত্র সব ভেসে গিয়েছিল। জাহাজে বসে রাজা রামমোহন রায় সময় নষ্ট না করে প্রিভি কাউন্সিলে যেসব বিষয়ের আলোচনা হবে সেইসব লিখতে বসে গেলেন। তিনি যুক্তিবাদী বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন তাই ভারতের অবর্ণনীয় দূঃখ দুর্দশার কথা সতীদাহ প্রথা যে কত নির্মম সেসব কথা বলবেন বলে লিখে ফেললেন।

 

 

সেকালে জাহাজে ইংল্যান্ড যেতে প্রচুর সময় লাগতো। ৮ই এপ্রিল ১৮৩১ সালে রামমোহন লিভারপুলে পৌঁছলেন। সেদিন জাহাজ ঘাটাতে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে বহু মানুষের সমাগম হয়েছিল। তাঁর খ্যাতি যে সমগ্র ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল তা লিভারপুলের জনসমাগম থেকেই বোঝা যায়। লিভারপুল থেকে রামমোহন লন্ডনে চলে এলেন। লন্ডনে তিনি রিজেন্ট স্ট্রিটে বাড়ি নিলেন। বেলা এগারোটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সকলেরই ভিড় থাকত রামমোহনের বাড়িতে। ১৮৩১ সালে রামমোহনকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টররা এবং তাঁকেরাজাউপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। এই কোম্পানি ভারতে দ্বিতীয় আকবরের দেওয়ারাজাউপাধি মেনে নেয়নি। ব্রিটিশ সরকার এভাবেই নিজেদের একটা ভুল শুধরে রামমোহনের রাজা উপাধি স্বীকার করে নেয়। যে উদ্দেশ্যে তিনি ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন সে কাজও করে ফেলেন এবং দ্বিতীয় আকবরের বাৎসরিক অনুদান বাড়ানো হলো তিন লক্ষ টাকার মতো। কিছুদিন পর শুরু হল প্রিভি কাউন্সিলে সতীদাহর শোনানি। বেথির সতীদাহর সওয়ালের উত্তরে রামমোহন একের পর এক ধারালো অস্ত্র দিয়ে বিধতে লাগলেন। রামমোহনের যুক্তির সামনে বেথি দাঁড়াতে পারলেন না কারণ বেথির সম্বল ছিল রক্ষণশীলদের তৈরি পাঁজিপুথি। নাকচ হয়ে গেল রক্ষণশীলদের আপিল।

 

 

 লন্ডনে এসে রামমোহনের অর্থ কষ্ট দূর হয়। মিস কিডিল নামে এক মহিলা স্টেপ্লটন গ্রোভে তাঁর নিজের বাড়ির অনেকটাই ছেড়ে দিলেন রামমোহনের জন্য। মিস কিডিলকে রাজা রামমোহন শ্রদ্ধা করতেন। নিজের পালিত পুত্রকে তাঁর কাছে রেখেই শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত করে তুলতে চেয়েছিলেন। মিস কিডিল, মিস ক্যাসেল, . কার্পেন্টরএর সঙ্গে রামমোহন রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে বেশ প্রফুল্ল ছিলেন এবং মানসিক শান্তিও পাচ্ছিলেন। একটানা পরিশ্রমে তার স্বাস্থ্য ভাঙতে লাগলো।

 

 

১৮৩৩ সালে ১৯শে সেপ্টেম্বর হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। জ্বর আর মাথার যন্ত্রণায় দুর্বল হয়ে গেলেন। ডেভিড হেয়ারের বোন রামমোহনের সেবা করতে লাগলেন। কিন্তু তিনি আর সুস্থ হয়ে উঠলেন না। ডাক্তাররাও আর কোন ভারসা দিতে পারলেন না। ডা ইস্টলিন তাঁর চিকিৎসা করছিলেন। রামমোহনের শেষের কয়েক ঘণ্টা সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন – ‘সেই রাতটা ছিল শুক্লপক্ষের। মি হেয়ার, মিস কিডিল, আর আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলামসেখানে গ্রামের শান্ত মধ্যরাত্রির বিস্তৃত দৃশ্যপট ছিল। অন্যদিকে ঘরের মধ্যে সেই অনন্য সাধারণ মানুষটি মৃত্যুর পথে চলেছিলেন। সেই মুহূর্তটি আমি কখনো ভুলব না।২৭শে সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ সালের রাত আড়াইটার সময় মিঃ হেয়ার ঘরে বসে বললেনসব শেষ হয়ে গেছে ১৮৩৩ সালে ১৮ই অক্টোবর স্টেপ্লটন গ্ৰোভে  সমাহিত করা হয় রাজা রামমোহনের দেহ। রাজার সঙ্গে যাদের বন্ধুত্ব ছিল তাঁরা সবাই তার শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া শেষ সেবায় যিনি ছিলেন সেই মিস হেয়ার, রাজার পুত্র রাজারাম, চাকুরেরা এবং ডাক্তাররা। রাজার মৃত্যুর দশ বছর পর দ্বারকানাথ ঠাকুর যখন লন্ডন গেলেন তখন তিনি স্টেপ্লটন থেকে রাজা রামমোহনের দেহআরনোস ভেলেসরিয়ে এনে সমাধিস্থ করেন।

 

 

রাজা রামমোহন রায় দুটো উদ্দেশ্য নিয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন এবং তিনি সফল হন। তিনি যখন লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন তখন কে জানত যে তিনি ভারতবর্ষের মাটি থেকে শেষবারের মতো চলে যাচ্ছেন আর ফিরে আসবেন না। আজ সমাজে সতীদাহ নেই কিন্তু আড়াইশো বছরেও কি পণ প্রথা বন্ধ হয়েছে? দেশে দুর্নীতি চলছে এবং নারীরা অত্যাচারিতা হচ্ছেন, তার থেকে কি নারী মুক্তি পাবে না ? আবারও কি রাজা রামমোহনের মত মহামানবের জন্ম এই ধরায় হবে না ? এমন এক মহামানবকে তাঁর সার্থদ্বিশত জন্মবার্ষিকীতে
আমার শতকোটি প্রণাম জানাই।

 

 

Leave a Reply