আকবর ও জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে কোচ–মুঘল সম্পর্ক সংক্ষেপে বর্ণনা কর। [History of
Cooch Behar]
আওরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষ পর্যন্ত কোচবিহারের শাসকদের সঙ্গে মুঘলদের সম্পর্কের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ। [History
of Cooch Behar]
কোচ–মুঘল সম্পর্ক। [History
of Cooch Behar]
Write a short account of the Mughal’s
relations with the rulers of Cooch Behar till the end of Aurangzeb’s reign. [History of Cooch Behar]
Describe briefly the Koch-Mughal relations
during the reign of Akbar and Jahangir. [History of Cooch Behar]
Koch-Mughal relations. [History of Cooch Behar]
উত্তর:
ভূমিকা:- জয় করা এবং সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার ব্যাপারে মুঘল বাদশাহীর পক্ষে বাংলাদেশ ছিল ভারতবর্ষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সমস্যাসংকুল রাজ্য দিল্লি থেকে দূরত্ব এবং নদীবহুল অঞ্চলের স্বাভাবিক দুর্গমতার ভৌগলিক কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সামরিক শক্তিতে বলিয়ান বঙ্গদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী আফগান শক্তি, যাদের যুযুৎসু মনোভাব আকবরের পক্ষে যথেষ্ট চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় বাংলাদেশে সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার উদ্দেশ্যে বাংলার উত্তর–পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত কুচবিহারের রাজা নারায়ণের সঙ্গে আকবর বন্ধুত্বমূলক সন্ধি করলেন (১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ)।
আকবরের সময় কুচবিহারের অবস্থা:
কোচবিহার বা কামতা রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে করতোয়া নদী এবং পূর্ব সীমান্তে সংকোশ নদী। কোচবিহার রাজ্যের অন্তর্দ্বন্দ্বে রাজ্যটির দুটি ভাগে খন্ডিত হয়েছিল, একটি কুচবিহার আরেকটি কামরূপ। দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ফলে দুটি ভাগই দুর্বল হয়ে পড়ে। কুচবিহার রাজ নারায়ণের পুত্র ও উত্তরাধিকারী লক্ষী নারায়ণের জাতি রঘুদেব রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কামরূপ নামে নতুন রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। রঘুদেবের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী রাজা পরীক্ষিত নারায়ণ এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের শাসক ছিলেন। তার পশ্চিম সীমা ছিল সংকোশ নদী আর পূর্ব সীমা বড় নদী। রাজপরিবারের প্রিয় বাসস্থান ছিল নদের তীরবর্তী বিলা, সরকারি রাজধানী ছিল মানস নদীর কূলবর্তী বরানগর, আর ব্রম্মপুত্রের তীরে অবস্থিত ধুবড়ি ছিল রাজ্যের প্রধান দুর্গনগর। কোচ রাজবংশের দুই শাখার মধ্যে বহুকালের বিরোধ আর সম্রাট আকবরের সঙ্গে রাজা নারায়ণের মিত্রতা চুক্তি এই দুটি অঞ্চল বাদশাহের সাম্রাজ্যিক বিস্তারের যন্ত্র স্বরূপ হয়ে দাঁড়াল, এবং ১৬৯৬ নাগাদ কুচবিহার মুঘল সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে পড়ল।
- মানসিংহের তৎপরতা:
নারায়ণের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী লক্ষীনারায়নকে মুসা খাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁর জ্ঞাতি রঘুদেব আক্রমণ করলে তিনি আকবরের শরণাপন্ন হন। তাঁর সাহায্যার্থে মানসিংহ দ্রুত সেলিমনগর থেকে গোবিন্দপুর চলে এলেন। সেখানে লক্ষীনারায়ন ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা করে তাঁর সঙ্গে মহা সমারোহে তাঁর বোনের বিবাহ দিলেন। মানসিংহের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে কুচবিহার রাজ্যের শত্রুরা যুদ্ধ না করে পালিয়ে গেল। রাজা লক্ষীনারায়ণ রাজা মানসিংকে নানাবিধ সম্মান ও উপহারে দুষ্ট করলেন। এইভাবে বাংলার উত্তর–পূর্ব সীমান্তে মুঘলদের একটি সামন্তরাজ্য সৃষ্টি হল।
জাহাঙ্গীরের আমলে মুঘল–কোচ সম্পর্ক:-
কুচবিহারের রাজা লক্ষীনারায়ণ নিজের স্বাধীনতা হারিয়ে তার উগ্ৰপ্রকৃতির জ্ঞাতি কামরূপের রাজা পরীক্ষিৎনারায়ণের বিরুদ্ধে মুগদের উত্তেজিত করে মনের ঝাল মেটাতে চাইলেন। ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত সুসঙ্গের রাজা রঘুনাথ আগেই মুঘলদের আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন। তাঁকে মুঘল সুবাদার ইসলাম খাঁর কাছে দূতরূপে পাঠিয়ে তিনি জানালেন যে মুঘলরা কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করলে তিনি তার সীমান্ত থেকে কামরূপ আক্রমণ করে মুঘলদের সাহায্য করবেন। মুঘল সুবাদার এই আমন্ত্রণের সুযোগ নিয়ে নয় মাসব্যাপী অভিযানের পরে কামরূপ জয় করলেন।
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খাঁর মৃত্যুতে সুবা বাংলার শাসন নীতির শুধু পরিবর্তন হল তাই নয় কুচবিহারের রাজার কপালও ভাঙল। নতুন সুবাদার কাশিম খাঁ কুচবিহারের রাজা লক্ষীনারায়ণ এবং কামরূপের রাজা পরীক্ষিৎ নারায়ণের ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করে তাঁদের নজরবন্দি করলেন। তারপরে তাঁদের জাহাঙ্গীর নগর থেকে অপসারিত করে সুদূর বাদশাহী রাজসভায় নির্বাসন দিয়ে তাদের চূড়ান্ত অপমান করলেন। এই অন্যায় ব্যবহারের প্রতিবাদে কোচবিহার এবং কামরুপে প্রচন্ড বিদ্রোহ শুরু হল। এই বিদ্রোহে উত্তর–পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলে নব প্রতিষ্ঠিত মুঘল কর্তৃত্বের ভিত্তি কেঁপে উঠেছিল। বিদ্রোহ দমনে মুঘল শাসককে বিশেষ বেগ পেতে হয়েছিল।
কামরূপ স্থায়ীভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও কুচবিহারের রাজা তাঁর হারানো এলাকার দিকে উৎসুক দৃষ্টিপাত করলেন। শাহজাহানের মৃত্যুর গুজব এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবার জন্য শাহ সুজা বাংলা ছেড়ে সসৈন্য চলে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে কুচবিহারের রাজ্যে প্রাণনারায়ণ (১৬৩৩–১৬৮৮) তাঁর মন্ত্রী ভবনাথ কর্জীকে কামরূপ জয় করার জন্য পাঠালেন। গৌহাটির বাদশাহী ফৌজদার লুৎফুল্লা সিরাজ হানাদারদের প্রতিরোধ করতে তার ছেলে ঝারুনাকে পাঠালেন। এদিকে বাংলাদেশ সীমান্তে অহোমরা কাজলি আক্রমণের জন্য নৌকা সংগ্রহ করল এবং নদী পার হবার জন্য সেতু নির্মাণ করল। একসঙ্গে দুই দিক থেকে সংখ্যাগুরু শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে লুৎফুল্লা পালিয়ে ঢাকায় চলে গেলেন। ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে অহোমরা বিনা যুদ্ধে গৌহাটি অধিকার করল।
শাহ সুজা ঢাকা থেকে বিতাড়িত হবার পরে ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে মীর জুমলা বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হলেন এবং বাদশাহের দ্বারা কোচবিহার এবং অহোম রাজাদের শায়েস্তা করার আদেশ পেলেন। তিনিও অভিযানের জন্য যথেষ্ট যত্ন সহকারে প্রস্তুত হয়ে ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দের পহেলা নভেম্বর ঢাকা থেকে যাত্রা করলেন। তাঁর বাহিনীতে ১২০০০ অশ্বারোহী, ৩০০০০ পদাতিক সৈন্য এবং বহু রণতরী বাদশাহী নৌকার এক বিশাল নৌবহর এবং এক শক্তিশালী গোলন্দাজের দল ছিল। জলে এবং স্থলে বাদশাহী বাহিনী দুর্জয় ছিল।
ঘন বাঁশঝাড় কাটতে কাটতে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে মুঘল বাহিনী ১৯শে ডিসেম্বর কোচবিহার রাজ্যের জনশূন্য রাজধানীতে পৌঁছল। রাজ্যটিকে তখন অনুষ্ঠানিকভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হল, আলমগীরের নামে মুদ্রা চালু করা হল এবং রাজধানীর নাম বদলিয়ে আলমগীর নগর রাখা হল। কুচবিহারের শাসনের সুবন্দোবস্ত করে এবং ইস্ফান্দিয়ার বেগকে দুর্গ রক্ষার জন্য মেতায়েন করে ৪ঠা জনুয়ারী মীর জুমলা আসাম বিজয়ের জন্য যাত্রা করলেন। কিন্তু গ্রীক বিয়োগান্ত নাটকে যেমন মানুষের পৌরুষের পরিণতি বিনাশ, মীরজুমলার আসাম বিজয়ের গৌরবের পরিণাম হল শোচনীয় ব্যর্থতা। মীর জুমলা বর্ষা–বান্যায় গড়গাঁওয়ে বন্দী থাকাকালীন কুচবিহারের রাজা তাঁর রাজ্য পুনরায় অধিকার করেছিলেন। অধিকন্তু মীর জুমলার মৃত্যুর পরে সুবা বাংলার শাসন ব্যবস্থায় বিশেষ বিশৃংখলা দেখা দেওয়ায় কুচবিহার পুনরুদ্ধারের অভিযানও সাময়িকভাবে স্থগিত থাকে।
১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খাঁ রাজমহলে পৌঁছলে কুচবিহারের রাজা সংবাদ পেলেন নতুন সুবাদার ঢাকার পথে কুচবিহার আক্রমণ করবেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে এবং তাঁর অপরাধের ক্ষমার মূল্যসরূপ সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা কর দিতে চেয়ে একখানি পত্র দিলেন। করে টাকা কিস্তিতে দেওয়া হয়েছিল। আস্কার খাঁর অধীনস্থ মুঘল ফৌজ কুচবিহারের সীমান্ত থেকে ফিরে আসে।