শিল্প ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে মুঘলদের অবদান কী? মুঘল স্থাপত্যের কোন নির্দিষ্ট শৈলী ছিল না বলা কি ঠিক?
What are the contributions of the Mughals in the field of
art and architecture? Is it proper to say that there was no specific Mughal
style of architecture?
মুঘল যুগে শিল্প ও স্থাপত্যের বিশদ বিবরণ দাও। স্থাপত্য রীতিতে মুঘলশৈলী ছিল না—একথা বলা যায় কি?
[Give an analytical survey of the art and architecture of Mughal India..
Do you agree that there were no Mughal style in architecture?]
মুঘল যুগে শিল্প ও স্থাপত্যের বিশদ বিবরণ দাও।
[Give an analytical survey of the art and architecture of Mughal India.]
স্থাপত্য রীতিতে মুঘলশৈলী ছিল না—একথা বলা যায় কি?
[Do you agree that there were no Mughal style in architecture?]
উত্তর :
ইসলামের বীর্যবত্তা ও চলিষ্ণুতা ইসলামকে স্পেন থেকে মঙ্গোলিয়ার প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। ভিনসেন্ট স্মিথ মনে করেন যে মুসলীম সৈন্যবাহিনী এসেছিল পারস্য সিরিয়া ও ইজিপ্ট থেকে। স্বভাবতই তাদের মধ্যে এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি দৃঢ়মূল থাকায় তারা সর্বত্র একটি সমন্বিত ঐস্লামিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল। ইউরোপে এই সংস্কৃতির প্রভাব স্যারাসেন সংস্কৃতি নামে পরিচিত। অধ্যাপক পার্সি ব্রাউন মনে করেন যে রক্ষণশীলতা এবং ইসলামের সামাজিকীকরণের মধ্যে ইসলামীয় সংস্কৃতি বিপুল রক্তপাতের পটভূমিতে স্থায়িত্ব লাভ করেছিল। আসলে ভারতে যে ইসলামীয় শিল্প গড়ে ওঠে তার মধ্যে হিন্দু প্রভাব স্পষ্ট হওয়ায় ইসলামীয় শিল্পরীতিতে নৈর্ব্যক্তিক শিল্প জন্ম নেয়। উইলডুরান্ট তাঁর ‘Our oriental heri tage’ গ্রন্থে বলেন যে হিন্দু স্থাপত্যে ভাব ও সৃজনশীলতা প্রকাশিত হয়েছিল। ইসলামীয় শিল্পে ছিল জ্যামিতিক সূক্ষ্মবোধ এবং সরলীকৃত সমন্বয়ীকরণ। ইসলামীয় শিল্পরীতিতে এসেছিল। রেনেসাঁ প্রকৃত পরিমার্জন। ভারতে ইসলাম স্তস্ত ও রোমান প্রভাবিত চিত্রিত দেওয়াল রীতি নিয়ে আসে। হিন্দু শিল্প যেখানে বৃহৎ প্রস্তর থেকে খোদাই করা ইট নির্মিত ছিল সেখানে ইসলাম শ্বেতপাথর ও রঙিন পাথরের ব্যবহার রীতি বিভিন্ন গম্বুজ ও খিলানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতে হিন্দু কলমরীতি ইসলাম গ্রহণ করে। সুলতানী যুগের শিল্পরীতিতে স্থানীয় প্রভাব ছিল স্পষ্ট, তবে মুঘলযুগের শিল্পে পারসিক প্রভাব উল্লেখযোগ্য। ধর্মীয় ক্ষেত্রে জামি মসজিদ সমরখন্দের বিবি খানমের অনুকরণে রচিত। এছাড়া ছিল বুলন্দদরওয়াজা, সেটি ১৪৩ ফুট উঁচু এবং লাল ও সাদা পাথরে তৈরি। এই দরজার গায়ে আকবর ধর্মীয় বাণী খোদাই করেছিলেন। সেলিম চিন্তির সমাধি মন্দিরটি একটি বিস্ময়কর বালি–পাথরে তৈরি ও মণি–মুক্তা শোভিত নিদর্শন।
জাহাঙ্গীরের সময়ে এই ইন্দো–ইসলামীয় এবং রাজপুত সংমিশ্রণ প্রসারিত ছিল। সিকান্দ্রার কাজ জাহাঙ্গীর সম্পন্ন করেন। বিশেষত বাগিচা শিল্পে জাহাঙ্গীরের উৎসাহ ছিল। জাহাঙ্গীরের সময়ে প্রস্তরীভূত শিল্পকর্ম থেকে শ্বেতপাথরের শিল্পকর্ম অধিক জনপ্রিয় হয়। দুষ্প্রাপ্য পাথর যেমন ল্যাপিজ, জ্যাম্পর, কর্ণেলিয়ান প্রভৃতির ব্যবহার শুরু হয়। নূরজাহান শ্বেতপাথর এবং pic tradura মোজাইক শিল্পের দ্বারা ইসৎ দৌল্লার সমাধিগৃহ নির্মাণ করেন। ফার্গুসন এই সমাধিগৃহের শিল্পরীতির সঙ্গে ফতেপুরসিক্রির সেলিমচিস্তির সমাধির শিল্পরীতির মিল পেয়েছেন।
নিঃসন্দেহে শাহজাহানের রাজত্বকাল মুঘল শিল্পের স্বর্ণযুগ। হিন্দু প্রভাবিত শিল্পরীতিটি তাঁর সময়ে সম্পূর্ণ পারসিক চরিত্র লাভ করে। রেনেগ্রুসেট তাঁর The civilization of East India গ্রন্থে ইস্পাহান ও কন্সট্যান্টিনোপলের আলোচনা করেছেন। শাহজাহানের সময়ে মুঘল অর্থনীতি ক্রমশ দুর্বল হতে থাকলেও শাজাহান দেওয়ান–ই–আম, সুসাম্মান বুর্জ, খোয়াবগাহ শিল্পরীতি ধর্মীয় এবং ধর্মরহিত বিষয়ে বিভাজিত। বাবর আলবেনিয়ার স্থপতি মিনানের শিষ্যদের ভারতে শিল্পকর্মের জন্য নিয়ে আসেন। পাণিপথের কাবুলিবাগ এবং সম্বলে জমি মসজিদ। এখনো বর্তমান আছে কিন্তু শিল্পগত উৎকর্ষ এখানে স্তিমিত। হুমায়ুন ভাগ্যবিপর্যয়ের মধ্যেও যে শিল্পে উৎসাহ দিয়েছিলেন তার প্রমাণ আগ্রা ও হিসারের দুটি মসজিদ। পারসিক স্থপতি মালিক মীর্জা ঘিয়াস ইন্দো–পারসিক রীতির মিশ্রণে হুমায়ুনের স্মৃতিমন্দির নির্মাণ করেন। বোধ হয় মুঘল শিল্পরীতির এটি প্রথম উল্লেখযোগ্য নিদর্শন, এটির গম্বুজ এবং খিলান রীতি পরবর্তীকালে তাজমহলের গঠনে অনুসৃত হয়েছিল।
পার্সি ব্রাউন আকবরের শিল্পরীতির মধ্যে ইন্দো–ইসলাম ও রাজপুত শিল্পরীতির গৌরবজনক সাম্যাবস্থা লক্ষ্য করেছেন। প্রাসাদ দুর্গ যা আগ্রায় এবং লাহোরে নির্মিত হয়েছিল সেগুলি ছিল বাংলা এবং গুজরাটের লালপাথরের ব্যবহারের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আকবরী মহল ও জাহাঙ্গীরী মহল ইসলামীয় ও রাজপুত রীতির সংমিশ্রণ। আগ্রার কাছে ফতেপুর সিক্রিতে তিনি স্থাপত্য শিল্পের একটি বিস্তৃত নমুনা রেখে গেছেন। আধুনিক দৃষ্টিতে এই শিল্পকর্মে অম্বর বা মাণ্ডুর প্রভাব ছিল স্পষ্ট। এটি অবশ্যই আকবরের ধর্মরহিত প্রেরণার ফসল। এছাড়া মহল শিল্পে যোধাবাঈ, মারিয়ম ও বীরবলের মহল চিত্রিত স্তত্ত্ব, অলিন্দনিক প্রয়োজনে আকবর দেওয়ান–ই–খাস রচিত করেন যা বৃহত্তম উদ্যোগ হিসাবে আরও পরিগণিত। বৃত্তাকার মঞ্চ এবং প্রস্ফুটিত পুষ্পের অনুকরণে মঞ্চে ব্যবস্থার এবং বিস্তৃত সভাগৃহে বিভিন্ন জ্যামিতিক গঠনে আসন ব্যবস্থা শিশমহলে নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া আকবরী মহল ও জাহাঙ্গীরী মহল তিনি সম্পন্ন করেন। নতুন শিল্পকর্মের মধ্যে তিনি দেওয়ান–ই–খাস, মতি মসজিদ ও খাসমহল নির্মাণ করেন। শাজাহানের সময়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য বিশেষত জাফরির কাজ প্রাধান্য পায়। গম্বুজের ভেতর দিকের ছাদে তিনি ইটালীয় রীতিতে বর্ণাঢা চিত্রশিল্প এবং দামী রঙিন পাথরের কাজ করান। আগ্রা থেকে দিল্লীতে রাজধানী স্থানান্তরকরণের সময় (১৬৩৮) শাজাহান প্রায় ১২ বছর সময় নিয়ে নতুন নগর শাহজাহানাবাদ–এর যেমন পত্তন করেন তেমনি তৈরি হয়। লালকেল্লা। বালিপাথরে ৯০০ x ৫৫০ মি. বিস্তৃত লালকেল্লা একটি অনবদ্য সৃষ্টি। এরই মধ্যে তিনি দেওয়ান–ই–খাস, রংমহল ও নবাবখানা নির্মাণ করেন। দুর্গের মধ্যে নহর–ই–বিহিত প্রবাহিত ছিল। ১০ লাখ টাকা খরচে ১০০ বর্গ মি. জমির উপর তিনি জামি মসজিদ নির্মাণ করেন।
শাজাহানের স্বপ্ন ছিল তাজমহল। এতে খরচ হয়েছিল আনুমানিক ৪১১৪৮৮২৬ টাকা। যমুনার তীরে ১৮৭ × ২৩৪ ফুট তাজমহল কল্পনা ও কাব্যের বিচিত্র সমাহার। তাজমহলের সবকটি দেওয়াল কারুকার্য শোভিত ও মণিমুক্তা সজ্জিত। তাজমহল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম ছিল।
ঔরঙ্গজেবের শিল্পকার্যে উৎসাহ ছিল না, তবু এরই মধ্যে লালকেল্লায় মতি মসজিদ নতুন করে নির্মিত হয়। দিল্লীর জামি মসজিদের অনুকরণে লাহোরে বাদশাহী মসজিদ নির্মাণ করেন। তবে অধ্যাপক শাস্তিস্বরূপ বলেন যে ঔরঙ্গজেবের শিল্পরীতিতে সেই বর্ণছটা ও অলংকরণ ছিল না। ধর্মীয় উন্মাদনায় ঔরঙ্গজেব বারানসীর বিশ্বেশ্বর মন্দির ধ্বংস করে সেখানে একটি মসজিদ এবং মথুরায় অনুরূপভাবে আর একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মায়ের স্মৃতিতে আজমশাহ তাজমহলের অনুকরণে আওরঙ্গাবাদে একটি স্মৃতিগৃহ নির্মাণ করেন। অষ্টাদশ শতকে সবদরজং–এর স্মৃতিগৃহ নির্মিত হয়। নবাব সুজাউদৌল্লা সবারজং–এর স্মৃতিতে এই বাগিচা শোভিত শিল্পকর্মটি সম্পূর্ণ করেছিলেন। তবে এই শিল্পে অনুপাতবোধ ও উজ্জ্বলতা অবশ্যই কম ছিল।
বাবর থেকে ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত মুঘল শিল্পকলার মধ্যে একটি শিল্পনৈতিক ক্রমবিকাশ লক্ষনীয়। বাবর ও হুমায়ুনের সূক্ষ্ম ব্যাপকতর যুদ্ধবিগ্রহ ও বিপর্যয়ের মধ্যে শিল্পকর্ম গৌণ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছে। কিন্তু আকবরের সময় থেকে ধর্মীয় প্রয়োজন এবং শিল্পনৈতিক প্রেরণা মুগল সম্রাটদের পরিচালিত করেছে। আকবর হিন্দু শিল্পরীতি, রাজপুত চিত্রশিল্প, বালি পাথর ও লাল পাথরের অলংকরণ ইসলামীয় শিল্পে নিয়ে আসেন। জাহাঙ্গীরের সময় থেকে শ্বেতপাথরের অলংকরণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। শাহজাহানের সময়ে শ্বেতপাথরের সঙ্গে সঙ্গে মণি–মুক্তা ও জাফরি খোদাস জনপ্রিয়তা অর্জন করে। খিলান চিত্রিত দরজা শোভিত স্তম্ভরীতি বৃহৎ শিল্পে ব্যবহৃত হয়। হিন্দু–মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয় আকবর ও কিছু পরিমাণে জাহাঙ্গীরের সময়ে হয়েছিল। শাজাহানের সময় সম্পূর্ণ পারসিক রীতি অনুসৃত হয়। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের সময়ে ধর্মীয় প্রেরণা ও শরিয়তি বিধান এত শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে মানবিক শিল্পকলার প্রকাশ অবরুদ্ধ হয়। আর্থিক দুর্বলতা ও অবক্ষয়া এবং সাম্রাজ্যিক সংকট পরবর্তী মুঘল সম্রাটদের আর স্থাপত্য ভাস্কর্যের জগতে টেনে নিয়ে আসতে পারেনি।
মুঘল স্থাপত্যশিল্পের মূল্যায়নে অনেকেই মৌলিকত্বের অভাব দেখেন। মুঘল শক্তি ভারতে কোনো সাংস্কৃতিক বা কৃষ্টিমূলক পরম্পরাকে জোর করে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেনি। ভারতে মুঘল যুগ একদিকে রাজ্য জয় অন্যদিকে সংরক্ষণের কাজে ব্যস্ত ছিল। স্বভাবতই নিজস্ব শিল্প–রীতি গড়ে তোলা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অধ্যাপক আসরফ বলেন মুঘল স্থাপত্যে হিন্দু ও মুসলিম রীতির সংমিশ্রণ দেখা যায়। ফতেপুর সিক্রির স্থাপত্যশৈলীতে সমতল ছাদের গঠন, ফুল, মালা জীবজন্তুর প্রতিকৃতি সবকিছুই এসেছিল হিন্দু স্থাপত্যরীতির প্রভাবে— প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ইসলামিক শিল্পরীতিতে এই ধরনের প্রকাশ নিষিদ্ধ ছিল।
অধ্যাপক পার্সি ব্রাউন মনে করেন ইসলামিক শিল্পরীতি সুলতানী যুগের শেষ থেকে ভারতীয় শিল্পরীতিতে গৃহীত হতে থাকে। ইউরোপে যেমন গথিকরীতি ইসলামিক স্থাপত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল যেমন গির্জাগুলিকে মসজিদে রূপান্তরের সময় খিলান বা জাস রিলিফ প্রভৃতি ক্ষেত্রে গথিক প্রভাব ইসলামীয় শিল্পরীতিকে প্রভাবিত করেছিল, তেমনি ভারতে হিন্দুরীতি বা অলঙ্করণ বিশেষ করে প্রাসাদ নির্মাণে, দালানে ছাদের কার্নিস, অলিন্দ, গবাক্ষ আচ্ছাদন বা রিলিফের কাজ হিন্দুরীতি থেকে এসেছিল। আকবর থেকে শাহজাহান পর্যন্ত মুঘল স্থাপত্যশিল্পের স্বর্ণযুগে হিন্দু স্থাপত্যরীতি রাজপুত নির্মাণকৌশল এমন কি দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পরীতি মুসলিম রীতিকে প্রভাবিত করেছিল। শিল্পরসিক ফারগুসনের অনুসরণে বলা যায় পৃথিবীর কোথাও কোনো শিল্পরীতি একান্ত মৌলিক বলে দাবী করতে পারে না। শিল্প সৌন্দর্য্যবোধ উদার বলেই সে অন্য রীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। সুতরাং মুঘল শিল্পরীতির মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক হিন্দু–মুসলিম সমন্বয় কাজ করেছিল। মুঘলদের ভারতীয়করণ ছিল বলে মুঘল শিল্পরীতি বলে স্বতন্ত্র কোনো রীতি দেখা যায়নি, সবটাই ছিল ভারতীয়।