তোষণ নীতি কী? ব্রিটেন ও ফ্রান্স তোষণ নীতি কেন গ্রহণ করেছিল? কীভাবে তা রূপায়িত হয়?
Table of Contents
পরিচিতি:
বিশ শতকের তিনের দশকে ইউরোপের একনায়কতন্ত্রী দেশগুলির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি কোনোরকম প্রতিরোধের বদলে যে আপস নীতি গ্রহণ করেছিল, তাকেই তোষণ নীতি বলা হয়। সোভিয়েতে সাম্যবাদ, জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিবাদ ও ইতালিতে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে ভীতি জন্মায় তা থেকে মুক্তি পেতে অবলম্বন করা হয় তোষণ নীতির। যদিও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বল্ডউইন (১৯৩৫-৩৭ খ্রি.) এই নীতির সূচনা করেছিলেন, তবে এর প্রবক্তা হিসেবে তাঁর পরবর্তী টোরি দলের প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেনকেই ধরা হয়। তোষণ নীতি আসলে ছিল এক ভ্রান্তনীতি।
তোষণ নীতি গ্রহণের কারণ/পটভূমি:
ভার্সাই সন্ধি:
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন মনে করতেন ভার্সাই সন্ধিতে জার্মানি ও ইতালির ওপর যথার্থই অন্যায় করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে চেম্বারলেন বলেছিলেন-হিটলারবাদ ভার্সাই সন্ধির অবিচারেরই কুফল। এর অন্যায় শর্তগুলি সংশোধিত হলে হিটলারবাদের ক্ষতিকারক ও খারাপ দিকগুলিরও বিলোপ হবে। তাই বিশ্বশান্তির তাগিদে ইতালি ও জার্মানির কিছু দাবি তিনি মেনে নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
বলশেভিক ভীতি:
ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি মনে করত নাৎসিবাদ ও সাম্যবাদ দুই-ই বিপজ্জনক, কিন্তু সাম্যবাদ নাৎসিবাদের থেকে বেশি বিপজ্জনক। এ ব্যাপারে ফরাসি বুর্জোয়াদের শ্লোগানই ছিল-হিটলার খারাপ, স্টালিন আরও বেশি খারাপ। আরও পরিষ্কার করে বলা যেতে পারে যে, বলশেভিক ভীতিই ছিল ইঙ্গ-ফরাসি তোষণ নীতির মূলে। তারা আশা করেছিল, হিটলার তার পূর্ব-ঘোষণা মতো পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে একদিন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। তাতে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি ইউরোপে শান্তিও বজায় থাকবে।
ইতালি-জার্মানি জোট গঠনের আশঙ্কা:
ইতালির প্রতি তোষণ নীতি গ্রহণের পেছনে ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির একটা অন্য ধরনের ‘ভয়’ কাজ করেছিল। সেটি হল-ইতালি পাছে নাৎসি জার্মানির সঙ্গে জোট বাঁধে। তাই যাতে জোট না বাঁধতে পারে সেদিকে নিশ্চিত হতে ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি ইতালিকে তোষণ করেছিল। কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হয়নি। তোষণ নীতির প্রয়োগ/রূপায়ণ:
ইতালির ক্ষেত্রে:
ইতালি আবিসিনিয়া আক্রমণ করলে (১৯৩৫ খ্রি.) জাতিসংঘ তার বিরুদ্ধে অবরোধের ডাক দেয়। জাতিসংঘের একটি প্রথম সারির শক্তিশালী সদস্য হয়েও ব্রিটেন কিন্তু ওই ডাক উপেক্ষা করে নানাভাবে ইতালিকে সাহায্য করে যায়।
জার্মানির ক্ষেত্রে:
i. ইঙ্গ-জার্মান নৌচুক্তি:
ভার্সাই চুক্তির শর্তকে লঙ্ঘন করে জার্মানি যে অস্ত্রসজ্জা করেছিল, ব্রিটেন জার্মানিকে তোষণ করবার জন্য তা মেনে নিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ইঙ্গ-জার্মান নৌচুক্তি (১৯৩৫ খ্রি.) নামে একটি সামরিক চুক্তিও দুটি দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তিতে জার্মানিকে ব্রিটিশ নৌবহরের ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত নৌবহর রাখার অনুমতি দেওয়া হয়।
ii. রাইন উপত্যকা অধিকার:
ভার্সাই ও লোকার্নো চুক্তির শর্তাবলি উপেক্ষা করে জার্মানি রাইন উপত্যকা অঞ্চলে অস্ত্রসজ্জা শুরু করে এবং বিনা বাধায় অঞ্চলটি দখল করে নেয় (১৯৩৬ খ্রি.)। ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা, বরং জার্মানির ওই আগ্রাসনকেই সমর্থন করে। চেম্বারলেন বলেন ‘জার্মানির নিজের জনগণের ওপরে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে।’
iii. স্পেনের গৃহযুদ্ধ:
স্পেনের গৃহযুদ্ধে জার্মানি ও ইতালি বিদ্রোহীদের নেতা জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সমর্থনে এগিয়ে গেলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে, যার জন্য হিটলার ও মুসোলিনি আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠেন।
iv. অস্ট্রিয়া অধিকার:
হিটলার আনস্লশ (সংযুক্তিকরণ) নীতি অনুসারে জার্মানির সঙ্গে অস্ট্রিয়াকে যুক্ত করলে ব্রিটিশ দূত নেভিল হেন্ডারসন বলেছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবে সংযুক্তিকরণ হলে ব্রিটেন বিরোধিতা করবে না। আর ফ্রান্স এ ব্যাপারে সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেও অস্ট্রিয়াকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। ইঙ্গ-ফরাসি তোষণের ফলে হিটলারের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বৃদ্ধি পায়।
v. মিউনিখ চুক্তি স্বাক্ষর:
হিটলার যখন চেকোশ্লোভাকিয়ার সুদেতান অঞ্চল আক্রমণে উদ্যত, তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন স্বয়ং বার্লিনে এসে হিটলারের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। পরে মুসোলিনির মধ্যস্থতায় চেম্বারলেন, ফরাসি প্রধানমন্ত্রী দালাদিয়ের, হিটলার ও মুসোলিনির মধ্যে সম্পাদিত হয় মিউনিখ চুক্তি (১৯৩৮ খ্রি.)। চুক্তি অনুসারে বিনাযুদ্ধেই চেকোশ্লোভাকিয়ার এক বিশাল অঞ্চল (১১,০০০ বর্গমাইল সুদেতান অঞ্চল) জার্মানির হাতে তুলে দেওয়া হয়। চেম্বারলেন হিটলারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন চেকোশ্লোভাকিয়ার সুদেতান অঞ্চল জার্মানির ন্যায্য পাওনা। জার্মানির প্রতি এমন নির্লজ্জ তোষণের উদাহরণ দ্বিতীয়টি নেই। এফ, এল. সুম্যানের মতে- ‘The Munich pact was the culmination of appeasement and warrant of death for the western democracies’।
PDF – তোষণ নীতি কী? ব্রিটেন ও ফ্রান্স তোষণ নীতি কেন গ্রহণ করেছিল? কীভাবে তা রূপায়িত হয়?
অথবা, ইঙ্গ-ফরাসি তোষণ নীতি
অথবা, ইঙ্গ – ফরাসি তোষণ নীতি বলতে কী বোঝায় ?
অথবা, ইঙ্গ-ফরাসি তোষণ নীতি
অথবা, ইঙ্গ-ফরাসি তোষণ নীতি