ফরাসী বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা | The Role of Philosophers in the French Revolution

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now

ফরাসী বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা?

To what extent did the philosopher affect the outbreak and course of the French Revolution?

ভূমিকা:

যে কোনো বিপ্লবের পূর্বে মানুষের চিন্তা বা ভাবজগতে বিপ্লব আসে। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী বিপ্লবের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়নী। অষ্টাদশ শতকে একদল সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের আবির্ভাব হয়, যারা ফ্রান্সের সমাজ, রাজনীতি ও ধর্মীয় জিবনে সর্বস্তরে পরিবাক্ত আলোচনা ও দুর্নীতির তীব্র সমালোচনা করে জাতীয় জীবনে এক বৈপ্লবিক ভবতরঙ্গের সৃষ্টি করে। তাদের সমালোচনার ফলে ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ দুর্নীতি, বৈষম্য এবং এর পাশাপাশি এদের নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে থাকে। দার্শনিকদের সমালোচনার ফলেই ফ্রান্সের পূরণ ব্যাবস্থার ভীত শিথিল হয়ে পরে।

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী বিপ্লবে যে সকল দার্শনিকরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল তাদের নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো –

ফরাসী বিপ্লবে মন্তেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫ খ্রি:) অবদানঃ-

ফরাসী দার্শনিকদের মধ্যে মন্তেস্কুর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। পেশায় আইনজীবী মনেস্কু নীয়মতন্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। মন্তেষ্কু তার যুক্তিবাদী চিন্তাকে ফ্রান্সের প্রচলিত সমাজ ও বিশ্লেষকের কজে লাগান। তার মতে ফ্রান্সের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ও অভিজাতিয় যুক্তি বহির্ভূত ব্যাবস্থা। মন্তেস্কুর চিন্তাধারার শ্রেষ্ট ফসল ছিল ‘Spirit of laws’  (আইনের মর্ম) নামক গ্রন্থটি। ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তার এই বিখ্যাত গ্রন্থটিতে রাজার ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতার ( Divine right of king) তীব্র সমালোচনা করেন। ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষাকল্পে রাষ্ট্রের শাসন আইন ও বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণের দাবি জানান । মন্তেস্কু বলেন যে যদি একই ব্যক্তির হাতে সরকারের আইন, বিচার ও কার্য নির্বাহ বিভাগ ন্যাস্ত থাকে তবে রাষ্ট্রের ব্যাক্তি স্বাধীনতা লোভ পাবে এ কারণেই এই তিন বিভাগকে পৃথক করার পরামর্শ দেন । তার এই মতবাদকে ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্ব ( Doctrine of desperation powers) বলা হয়। মন্তেস্কুর এই গ্রন্থখানি পরবর্তীকালে ফ্রান্সের বিপ্লবী শাসনতান্ত্রিক রচনায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।  মন্তেস্কু তার ‘The Persian letters’ নামক অপর গ্রন্থে সমাজ ব্যাবস্থা, অভিজাতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের দুর্বলতা ও ত্রুটির কঠোর সমালোচনা করেন।

 

ফরাসী বিপ্লবে ভলতেয়ারের(১৬৯৪-১৭৭৮ খ্রি) অবদানঃ-

ফ্রান্সের বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ভলতেয়ারের। তার আসল নাম মারি ফ্রাসোয়া আরয়েৎ। কবি, নাট্যকার, প্রবন্দিক,দার্শনিক ও ঐতিহাসিক ভলতেয়ার ছিলেন সমকালীন সাহিত্য জগতের মধ্যমণি এবং সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল। ভলতেয়ার ছিলেন তীক্ষ্ম ব্যাঙ্গ রচনার পারদর্শী। প্রগতিবাদী ও যুক্তিবাদী ভলতেয়ারের কাছে অযুক্তিকতা অসহ্য ছিল। ঈশ্বরবাদী হওয়া সত্বেও তার অক্রমনের প্রধান লক্ষ্য ছিল ক্যাথলিক গীর্জা। কারণ তার মতে গীর্জা ছিল প্রগতি ও শিক্ষার পরিপন্থী। ক্যাথলিক গির্জা কে তিনি “বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত উৎপাত” বলে অভিহিত করেন। তীব্র বিদ্রুপ ও শ্লোসাত্মক রচনার মাধ্যমে তিনি নীর্জার দুর্নীতি সামাজিক ও বৈষম্য সর্ব সন্মুখে তুলেধরে দেশে এক জাগরণের সৃষ্টি করে । গণতন্ত্রে বিশ্বাসী না হয়েও তিনি শাসন তান্ত্রিক সংস্কার ও স্বাধীন চিন্তার সমর্থক ছিলেন। প্রজাহিতাসি রাজতন্ত্রের নিন্দায় মুখর ছিলেন। তার দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ কাঁদিত ও লেতর ফিলোসফিক ।



ফরাসী বিপ্লবে রুশো (১৭১২-১৭৭৮) অবদানঃ-

ফরাসী দার্শনিকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় প্রগতিশীল ছিলেন জাঁ জেকুইস রুশো। তাকে ফরাসী বিপ্লবের জনক বলা হয়। রুশো তার অসাম্যের সূত্রপাতগ্রন্থে দেখান যে মানুষ সমান অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে । কিন্তু লোভী ও সার্থপর
সমাজ বেবস্থা তাকে বঞ্চিত করে। এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি সামাজিক বৈষম্য
, শ্রেণীগত পার্থক্যে কুঠারাঘাত করেন।
রুশোর বিখ্যাত সর্বাপেক্ষা গ্রন্থ হলো সামাজিক চুক্তি (Social Contract)এই গ্রন্থে তিনি আধুনিক গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রবাদের ভিক্তি স্থাপন করেন। নানা যুক্তি তথ্যের মাধ্যমে তিনি রাজার ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা নস্যাৎ করে বলেন যে জনগনই হলো সমস্ত রাষ্ট্র, সার্বভৌম শক্তির উৎস । ঈশ্বর নয় একদিন জনগণের ইচ্ছে অনুসারে (General will) এক চুক্তির মাধ্যমে রাজা সিংহাসনে বসেন। সতুরাং তিনি স্বৈরাচারী হয়ে চুক্তি লঙ্ঘন করলে প্রজা সাধারণত পদচ্যুত করতে পারবে। তার এই সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাজার দৈব শক্তির মুলে আঘাত হানে ও প্রজার মনে রাজার কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পেরণা যোগায়।  রুশোর অপর দুই বিখ্যাত গ্রন্থ হলো হেলোইজ এবং এমিল(Helois and Emile)লেফেভারের মতে সামাজিক চুক্তি অপেক্ষা এই দুটি গ্রন্থের প্রভাব ছিল বেশি।

বিশ্বকোষ প্রণেতা:

বিশ্বকোষ রচৈতারা ফ্রান্সের যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সাহায্য করে। ডেনিস দীদের, ডি এলেমবার্দ (D. Ellembart) প্রমুখ ছিলেন বিশ্বকোষ প্রণেতাগন। এই গ্রন্থে বিভিন্ন দার্শনিকদের রচনা স্থান পেয়েছে। ফরাসী দার্শনিকরা যে গ্রন্থ রচনা করতো তার ভাব ভাষা ছিল বিমূর্ত যা সর্ব সাধারণের বোধগম্য ছিলনা। দার্শনিকদের মতামত গুলিকে সহাজকরে প্রকাশ করা হয় এই গ্রন্থগুলির মাধ্যমে। এছাড়া বিশ্বকোষ প্রণেতারা নিজেদের মানবতাবাদী এবং উপযোগবাদি দর্শনের প্রকাশ ঘটান এই গ্রন্থের মাধ্যমে। বিশ্বকোষ গ্রন্থটি ফ্রান্সের সাধারণ মানুষকে প্রচলিত সমাজ রাষ্ট্র ও ধর্মীয় জীবনের বিভিন্ন ত্রুটি
সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।

ফিজিওক্র্যাট:

অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে ফিজিওক্র্যাট নামে এক শ্রেণীর অর্থনীতি বাদের আবির্ভাব হয়। ফ্রান্সের শিল্প বাণিজ্য ছিল রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। ফিজিওক্র্যাটরা মাকেন্টাইল বা সংরক্ষণ নীতি বা এবং শিল্প বাণিজ্যের রাষ্ট্রের নীতির বিরোধী ছিলেন। তাদের অবাধ বাণিজ্য ও বেসরকারি শিল্প স্থাপনের দাবি জানায়। ইংল্যান্ডের অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মীত তার ওয়েলথ অব নেশন গ্রন্থে এই মতবাদের সূচনা করেন । ফ্রান্সে এই মতবাদের প্রবক্তা হলেন কুইসনে।

ফরাসী বিপ্লবে অন্যান্য দার্শনিকদের অবদান:

উপরিউক্ত দার্শনিকগণ ছাড়াও আরও অনেক দার্শনিক ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের জনগণের চিন্তা ভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল। লা মেত্রী, কাদিলাত, হলবাফ, মারেলি মাঠেলি প্রমুখ বিশিষ্ট পন্ডিত জনগণের চিন্তা চেতনাকে নতুন স্তরে পৌঁছে দেয়।

মূল্যায়ন:

দার্শনিকদের মতামত প্রত্যক্ষ ভাবে বিপ্লবের সৃষ্টি না করলেও ত পরোক্ষভাবে বিপ্লবের সৃষ্টি করে। পুরান্তন্ত্র বা ফ্রান্সের বা ফ্রান্সের পুরাতন সমাজ ও শাসন ব্যাবস্থার ত্রুটি উল্লেখ করে এই বেবস্থা সম্পর্কে জনসাধারণের আস্থা নষ্ট করেন। সাধারণ লোক তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা বুঝতে পারে। প্রচলিত সমাজ ব্যাবস্থা সম্পর্কে দর্শকদের সমালোচনা এমন একটি পেরণার সৃষ্টি করে যার প্রভাব পুরাতন তন্ত্র ভেঙে পড়ে। বিপ্লবীদের মানসিক প্রস্তুতি গঠনে সাহায্য করে। লেফেভার বলেন যে ফরাসী দার্শনিকরা অভিজাতদের বিশেষ অধিকার সমন্তপ্রথা সৈচারি শাসনের তীব্র সমালোচনা দ্বারা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের যোগান দেন। এই দার্শনিকগণ বিশেষত রুশোর বক্তব্য যে “মানুষ স্বাভাবিক ভাবে জন্মগ্রহণ করলে তাকে সর্বত্র শৃঙ্খলিত করা” ফ্রান্সের তৃতীয় শ্রেণীর বিবেককে জাগায়। যদিও ফরাসী বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

 

Read Offline – PDF ফরাসী বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা

1 thought on “ফরাসী বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা | The Role of Philosophers in the French Revolution”

Leave a Reply