প্রশ্ন:- বৈদিক যুগের ধর্মীয় অবস্থা আলোচনা কর?
অথবা, বৈদিক যুগে প্রধান দেবদেবী কারা ছিলেন ?
অথবা, ঋক বৈদিক যুগের ধর্ম ভাবনা আলোচনা করো।
অথবা, ঋক্-বৈদিক আর্যদের ধর্মীয় বিশ্বাস বিষয়ে যা জানো লেখো।
অথবা, ঋক বৈদিক যুগ এবং পরবর্তী বৈদিক যুগের ধর্মীয় ভাবনা।অথবা, ঋক বৈদিক যুগের ধর্মীয় অবস্থা ও দেবদেবী সম্পর্কে তোমার ধারণা লেখ।
Answer:-
বৈদিক যুগের ধর্ম:–
ঋক বৈদিক যুগের আর্যদের ধর্ম ছিল খুব সহজ ও সরল। ঋকবেদ থেকে আমরা পূর্ববর্তী বৈদিক যুগের আর যদি ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারি। প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে ঋক বৈদিক আর্যরা দেব দেবী জ্ঞানে উপাসনা করত। তারা বিশ্বাস করতো যে প্রকৃতির রহস্যের অন্তরালে কোন দৈব শক্তি কাজ করে। আর প্রতিটি বস্তুর মধ্যে প্রাণ আছে এই ছিল তাদের বিশ্বাস।
ঋকবেদে বহু দেবতার উল্লেখ আছে।দেবতাদের বাসস্থান হিসেবে তাঁদের তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে, যেমন-
- আকাশের দেবতা (সূর্য, মিত্র, বরুণ, সাবিত্রী, পুষণ, ঊষা)
- বায়ুর দেবতা (ইন্দ্র, রুদ্র ও মরুৎ) এবং
- পৃথিবীর দেবতা (অগ্নি, সরস্বতী ও সোম)।
বিভিন্ন ঋষির কাছে একই দেবতা বিভিন্নভাবে কল্পিত হয়েছেন, তাই বিভিন্ন স্রোত্রে একই দেবতার গুণ ও বিশ্লেষণ ভিন্ন ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ কোন কোন স্রোত্রে ইন্দ্র বৃষ্টির দেবতা, কখনো ধন দেবতা, কখনও যুদ্ধ ও ধ্বংসের দেবতা, কখনও গো-দাতা, কখনো বা তিনি নদীর বাঁধ ধ্বংসকারী দেবতা ইত্যাদি। প্রথমে বজ্রধারী ইন্দ্রই ছিলেন প্রধান দেবতা। ইন্দ্রের পরে অগ্নি ও বরুণের অবস্থান। ঋকবেদে অগ্নি ছিলেন শ্রদ্ধা-ভক্তি ও মর্যাদার অধিকারী। তাই আর্যদের ঘরে ঘরে অগ্নিকুন্ডে সর্বদা অগ্নি প্রচলিত রাখার ব্যবস্থা ছিল। বরুন শান্তি রক্ষক, পাপ-পুণ্যের ধারক, ন্যায়-নীতির রক্ষক ইত্যাদি। মিত্র ছিলেন সন্ধি, শপথ ও প্রতিরক্ষার দেবতা। সূর্য ছিলেন আলোর দেবতা। মরৎ ছিলেন ঝড়ের দেবতা। রুদ্ধ ছিলেন ধ্বংসের দেবতা। সাবিত্রী ছিলেন সূর্য মন্ডলে অধিষ্ঠাত্রী ও প্রাণ দাত্রি। ঋকবেদে সরস্বতী ছিলেন নদীর দেবতা। আজকের মত তিনি বিদ্যার দেবী নন। ঋকবেদে ঊষা, সাবিত্রী, পৃথিবী, সরস্বতী, রাত্রি প্রভৃতি নারী দেবতার উল্লেখ আছে। তবে নারী দেবতার সংখ্যা পুরুষ দেবতার চেয়ে ছিল কম। Dr. H. C. Roy Chowdhury-র মতে, একেশ্বরবাদ হল ঋকবেদের অন্য এক বৈশিষ্ট্য। ঈশ্বর অনেক নামে রচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। এই প্রসঙ্গে ঋগ্বেদের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘একং সাদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’ স্মরণীয়।
ঋক বৈদিক যুগে আর্যদের সহজ, সরল, উপাসনা পদ্ধতিতে পৌত্তলিকতা ও মন্দিরের কোন স্থান ছিল না। ধরনের কেন্দ্র ছিল যজ্ঞ, তবে যজ্ঞ পদ্ধতি ছিল খুবই সাধারণ। তখন সকল স্তরের মানুষের বিশ্বাস ছিল যে যজ্ঞ কালীন প্রার্থনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থাকে না।
পরবর্তী বৈদিক যুগের ধর্মীয় অবস্থা:-
পরবর্তী বৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবনে যে ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হলপুরোহিতদের গুরুত্ব ও প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। তাদেরই নির্দেশে রচিত ‘ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থে ধর্মচর্চার জটিলতা বৃদ্ধি পায়। যজ্ঞ অনুষ্ঠানের জটিলতা ঋক বৈদিক যুগ অপেক্ষা বেড়ে যায়। পুরোহিত সম্প্রদায়ের শ্রেণীবিন্যাস ঘটে। যজ্ঞকালে একাধিক পুরোহিতের প্রয়োজন হয়। সবার উপরে স্থান ব্রাহ্মণের, যিনি সর্বোচ্চ পুরোহিত হিসেবে যজ্ঞের জটিল প্রক্রিয়া পরিচালনা করতেন। হোত্রী মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে দেবতার আহ্বান করতেন।উদগাত্রী সামবেদ গাইতেন। অধ্বুর্য পুঁথি থেকে মন্ত্র পাঠ করতেন।
পরবর্তী বৈদিক যুগের বৈদিক যুগের দেবতার গুরুত্ব হ্রাস পায়। ইন্দ্র ও অগ্নির মতো ঋক বৈদিক দেবতা পরবর্তী বৈদিক যুগে মর্যাদা হারান। অন্যদিকে জীব জগতের স্রষ্টা হিসেবে প্রজাপতি ব্রম্মা, রুদ্র (শিব), এবং বিষ্ণু বিশেষ গুরুত্ব পান। গান্ধর্ব অপ্সরা ও নাগদের উপর কিছুটা দেবত্ব আরোপিত হয়। গবাদি পশুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা পূষণ শূদ্র দেবতার মর্যাদা লাভ করেন।
পরবর্তী বৈদিক যুগে যাগযজ্ঞ নির্ভর ব্রাহ্মণ্যধর্মের পাশাপাশি একটি দার্শনিক ধর্মচিন্তার উদ্ভব হয়। যা জন্মান্তরবাদ ও কর্মফলবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। আরণ্যক ও উপনিষদে এর পরিচয় পাওয়া যায়। উপনিষদে দেবতার বহুত্বের পরিবর্তে বলা হয়েছে ঈশ্বর এক ও অভিন্ন। মানবাত্মা হল পরত্মার অঙ্গ। পরবর্তী বৈদিক যুগে আধ্যাত্মবাদের পাশাপাশি জড়বাদী দর্শনের উদ্ভব হয়েছিল। এর প্রবক্তা ছিলেন ঋষি উদ্দালক। এই জড়বাদী তত্ত্ব থেকে পরবর্তীকালে চার্বাক দেহতত্ত্বের উদ্ভব ঘটে।
Reference
1. Image Credit – commons.wikimedia.org (https://commons.wikimedia.org/wiki/File:Or_de_Varna_-_Bijoux.jpg)