Q. Analyze the socio-Economic condition of the Early Vedic Period. What was a noticeable change in the later Vedic Period?
Or, Describe the socio-economic condition of the early Vedic Age.
Or, Difference between the early Vedic period and the later Vedic period.
প্র: আদি বৈদিক যুগের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ কর। পরবর্তী বৈদিক যুগে লক্ষণীয় পরিবর্তন কী ছিল?
অথবা, বৈদিক যুগের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বর্ণনা কর।
অথবা, বৈদিক কাল এবং পরবর্তী বৈদিক সময়ের মধ্যে পার্থক্য।
Answer:
ঋক বৈদিক যুগের সামাজিক জীবন:-
পারিবারিক জীবন:-
ঋক বৈদিক আর্যরা সংগঠিত সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। রাষ্ট্রের মত সমাজের ভিত্তি ছিল পরিবার। পরিবার ছিল পিতৃতান্ত্রিক, অর্থাৎ পরিবারের সর্বাপেক্ষা বয়স্ক পুরুষ বা কর্তা ‘গৃহপতি’ হিসেবে গণ্য হতেন। পরিবারের উপর পিতার দায়িত্ব বা কর্তৃত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধন ছিল। সন্তানের উপর পিতামাতার কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত ছিল। অবশ্য পিতা পুত্রের সম্পর্ক ছিল স্নেহ ও শ্রদ্ধার। পিতার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠপুত্র পরিবারের দায়িত্ব লাভ করতেন। বেদে ‘অতিথি’ শব্দের ব্যবহার থেকে অনুমান করা যায় যে, অতিথি সেবাকে তৎকালীন সমাজে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত।
সমাজে নারীর স্থান:-
ঋক বৈদিক সমাজে নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হত। যেহেতু সমাজ ছিল পিতৃতান্ত্রিক, সেহেতু সকলেই পুত্র সন্তান কামনা করত। কিন্তু কন্যা সন্তানকে অবহেলা করা হত না। নারীরা সেযুগে পর্দানশীন ছিলেন না, স্ত্রীশিক্ষার সুযোগ ছিল। ঘোষা, মমতা, অপালা, বিশ্ববরার মতো নারী’রা শিক্ষার উচ্চতম স্তরে পৌঁছে ছিলেন। এমনকি দর্শনশাস্ত্র পাণ্ডিত্য লাভ করেছিলেন এবং বৈদিক মন্ত্রও রচনা করেছিলেন। এই যুগে লোমশা, পৌলোমী ও বশমায়নীর মতো নারীরা ধর্মীয় সাধনায়ও বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছিলেন। বিবাহকে পবিত্র ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধন বলে মনে করা হত। সমাজে বাল্য বিবাহের প্রচলন ছিল না। পতি নির্বাচনে মেয়েদের স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু ব্যতিক্রম থাকলেও এক পতিই ছিল প্রচলিত রীতি। তবে পুরুষদের ক্ষেত্রে একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল না। বিধবা বিবাহ অনুমোদিত ছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর সতী হওয়ার কোন নির্দেশ বৈদিক সাহিত্যে নেই। বিধবা নারীরা কুল বা জাতির মধ্যেই পুনর্বিবাহ হওয়ার রীতি ছিল। সুতরাং সহমরণ এমনকি কঠোর বৈধতা যাপন কোনটিই ঋক বৈদিক যুগে প্রচলিত ছিল না। নারীদের নৈতিক চরিত্রের মানও ছিল উন্নত। এযুগের নারী জনসভায় অংশগ্রহণ করতেন। ঋকবেদের নারীকে যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। বীর নারী বিষ্পলা যুদ্ধে তার পা হারিয়েছিলেন।
বর্ণপ্রথা:-
ঋক বৈদিক যুগে জাতিভেদ প্রথা ছিল কি না, এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক দের মধ্যে মতবিরোধ বিদ্যমান। অনেকে ঋক বৈদিক যুগে জাতিভেদ প্রথায় বিশ্বাসী। ঋকবেদের দশম মন্ডলের অন্তর্গত বিখ্যাত পুরুষসুক্তে উল্লেখ আছে যে, আদি পুরুষ বা ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণের, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়ের, উরুদেশ থেকে বৈশ্যের, ও তাঁর পদযুগল থেকে শূদ্রের উদ্ভব হয় এবং সমাজ চার জাতিতে বিভক্ত ছিল। সমালোচকদের মতে, পুরুষসূক্তের এই বর্ণনা সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এর সবচেয়ে বড় ত্রুটি হল যে এই শ্লোকটি পরবর্তীকালে প্রক্ষিপ্ত। সুতরাং পরবর্তীকালে রচিত ও রচনার ভিত্তিতে সমগ্র ঋক বৈদিক যুগের বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করা ইতিহাস সম্মত নয়। ঐতিহাসিক A. L. Basham, D. D. Kosambi বলেছেন যে, ঋক বৈদিক যুগে জাতিভেদ ছিল না। তাদের মধ্যে তখন সমাজে বর্ণ ও শ্রেণী বৈষম্য ছিল এবং বর্ণবৈষম্য ব্যাপারে সবাই মোটামুটি একমত। ঋক বৈদিক যুগের প্রথম দিকে সমাজ বর্ণের ভিত্তিতে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল- আর্য ও অনার্য। আর্যরা ছিল গৌরবর্ণ ও দীর্ঘকায় এবং অনার্যরা ছিল কৃষ্ণবর্ণ ও তুলনামূলকভাবে খর্বাকার। ঐতিহাসিক R.S. Sharma-র মতে “কৃষ্ণকায় অনার্য থেকে গৌরবর্ণ আর্যদের পার্থক্য বোঝানোর জন্য বর্ণের ভিত্তিতে সর্বপ্রথম আর্য সমাজের শ্রেণী ভেদের উদ্ভব হয়, জাতিগত অর্থে নয়।” ধীরে ধীরে জীবন জটিল হলে বা জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে গুণ এবং কর্মের ভিত্তিতে সমাজে চারটে শ্রেণীতে বিভক্ত হয়- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। যারা বিদ্যাচর্চা যজ্ঞাদিতে নিযুক্ত ছিলেন তাঁরা ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত হন। যারা যুদ্ধকার্যে, দেশ রক্ষা ও দেশ শাসনে নিযুক্ত থাকতেন তারা ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত হতেন। যারা কৃষি, ব্যবসা, বাণিজ্য ও পশু পালন করতেন তারা বৈশ্য নামে পরিচিত হন। আর যারা এই তিনটি শ্রেণীর সেবায় নিযুক্ত হতেন, তারা শূদ্র নামে অভিহিত হন, এভাবে বৃত্তি অনুসারে সমাজে চারটি শ্রেণীর উদ্ভব হয়। তখন নিজ বৃত্তি ত্যাগ করে অপর শ্রেণীর বৃত্তি গ্রহণ, মিলিতভাবে আহার গ্রহণ এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনে বাধা ছিল না। ব্রাহ্মণ পুরুষ, ক্ষত্রিয় নারীকে বিবাহ করত এমন বৃত্তিতে নিযুক্ত ছিলেন, এমন প্রমাণ আছে। ঋকবেদের কোন এক স্রোত্রে উল্লেখ আছে যে, “I am a poet, My father is a doctor and My Mother is a grinder of Carn.” ( সুতরাং বলা যায় যে, ঋক বৈদিক যুগে জীবিকা জাতিভিত্তিক এবং বংশানুক্রমিক হয়ে ওঠেনি। গুন ও জ্ঞান অর্জন করতে পারলে অপর বৃত্তির লোকেরাও উচ্চতর বৃত্তি গ্রহণ করতে পারতেন) ঋক্ বৈদিক যুগে অস্পৃশ্যতা, খাদ্যের ব্যাপারে ছোঁয়ার কোন বাধা নিষেধ ছিল না। তবে পরবর্তী বৈদিক যুগে জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব হয়।
চতুরাশ্রম:-
চতুরাশ্রম ছিল আর্য সমাজের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই অবস্থা সমাজের প্রথম তিন শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই প্রথা অনুসারে জীবনকে চারটি আশ্রমে বিভক্ত করা হত, যথা- ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। জীবনের প্রথম আশ্রম কে বলা হত ব্রহ্মচর্য। বাল্যে ও কৈশরে গুরুগৃহে থেকে বিদ্যা চর্চা করতে হত। যৌবনে বিবাহ করে সংসার ধর্ম পালন বা গার্হস্থ্য আশ্রম ছিল দ্বিতীয় পর্যায়ে। পৌঢ় অবস্থায় তৃতীয় আশ্রম ছিল বানপ্রস্থ। সেই সময়ে সাংসারিক দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে নিলিপ্ত জীবন অতিবাহিত করতে হত। সর্বশেষ পর্যায় কে বলা হয় সন্ন্যাস। এই সময়ে সংসার ত্যাগী সন্নাসীর মতো ইহলৌকিক বিষয়ে নিরাসক্ত হয়ে ঈশ্বর চিন্তায় মগ্ন থাকতে হত। তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে Prof. R. S. Sharma-র মতে, “আর্যদের চতুরাশ্রম রীতি পরবর্তী বৈদিক কালে সৃষ্টি হয়”।
খাদ্য, পোশাক-অলংকার ও আমোদ-প্রমোদ:-
ঋক বৈদিক যুগে আর্যদের খাদ্যাভাস ছিল সাধারণ এবং অনাড়ম্বর। দুধ, দুগ্ধজাত দ্রব্য, তরকারি, ফল, মাছ এবং মাংস তাদের খাদ্যের তালিকায় প্রাধান্য পেয়েছিল। গো মাংস আহার নিষিদ্ধ ছিল না। তবে দুগ্ধজাত গাভী হত্যা নিষিদ্ধ ছিল। আর্যরা দুই প্রকার উত্তেজক পানীয় ব্যবহার করত। একটি হল সূরা (সাধারণ পানীয়) এবং অপরটি হল ‘সোমরস’, যা বিশেষ উৎসবের দিন পালন করা হত।
এ যুগে আর্যদের নারী ও পুরুষের পোশাকের বিশেষ কোনো তারতম্য ছিল না। তিন প্রকার পোশাকের প্রচলন ছিল- i) নিবি বা অন্তর্বাস, ii) বহির্বাস iii) অধিবাস বা আংরাখা। পোশাক-পরিচ্ছদ তুলা, পশম, মৃগচর্ম দিয়ে তৈরি হত। নারী-পুরুষ উভয়েই পাগলী ব্যবহার করতো বলে মনে করা হয়। নারী-পুরুষ উভয়েই অলংকার পরিধান করত। অলংকার প্রধানত সোনা ও মূল্যবান পাথর দিয়ে তৈরি হত।
এযুগে আর্যদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিরানন্দময় ছিলনা। আমোদ-প্রমোদের যথেষ্ট ব্যবহার ছিল। ঋকবেদ থেকে জানা যায় যে পাশা খেলা, মুষ্টিযুদ্ধ, রথের দৌড়, শিকার, নিত্য গীত প্রভৃতি ছিল দৈনন্দিন আমোদ-প্রমোদের অঙ্গ। সমাজে জুয়া খেলা নিন্দনীয় হলেও বহু লোক এর প্রলোভনে পড়ত। আর্যদের সংগীত ও চারুকলার দিকে ঝোঁক ছিল। বাঁশি, বিনা ও ঢোলক সহ তারা নিত্যগীত করত। পেশাদারী নর্তকীরা নৃত্যকলায় পারদর্শী ছিল।
পরবর্তী বৈদিক যুগে সামাজিক অবস্থার লক্ষনীয় পরিবর্তন:-
পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যদের সমাজব্যবস্থায় যেসব প্রথা ও রীতিনীতি পরিবর্তিত হয় তা পরবর্তী বৈদিক সমাজে পরিবর্তন বিধানে সহায়ক হয়ে ওঠে, যেমন-
প্রথমত, পূর্ববর্তী বৈদিক স্তরে গুণ ও কর্ম অনুসারে সমাজের শ্রেণী বা বর্ণবিভাগ স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তী স্তরে সেই বর্ণ বিভাগ জন্ম ভিত্তিক জাতি গঠনে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের সন্তানরা যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রই থাকবে। এক্ষেত্রে গুণের কোন বিচার থাকবে না, পূর্ববর্তী বৈদিক সমাজের পেশাভিত্তিক বর্ণভেদ প্রথা কঠোর জাতিভেদ প্রথায় রূপান্তরিত হয়। এই সময় থেকেই উচ্চতর দুই জাতির তুলনায় বৈশ্যদের সামাজিক মর্যাদা ক্রমশ কমতে থাকে। সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা হয় শুদ্রদের। সমাজের কাঠামো শুদ্রদের স্থান সবার নিচে স্থাপন করা হয়।
দ্বিতীয়ত, ঋক বৈদিক যুগের মতো পরবর্তী বৈদিক যুগেও সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল পরিবার এবং গ্রাম। তবে এই যুগে নগরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
তৃতীয়ত, এযুগের সমাজে নারীদের অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা ঋক বৈদিক যুগ অপেক্ষা অনেকাংশে খর্ব হয়। বেদের ব্রাহ্মণ ও সংহিতা অংশে তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐতরেও ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে , কন্যা হল অভিশাপ। শিক্ষায় ও চিন্তায় লাভ করেছিল বটে, কিন্তু তা ছিল ব্যতিক্রম মাত্র। এ যুগে নারী কে পুরুষের ভোগ্য রূপেই দেখা হয়েছে। সর্ব গুণান্বিতা শ্রেষ্ঠা নারীও অধমতম পুরুষের থেকে হীন বলে গন্য ছিলেন। সম্পত্তির অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হয়, রাজনৈতিক অধিকার ও তাদের ছিল না। তারা গৃহপ্রাঙ্গণে বন্দিনী হন। বিবাহের নিয়মকানুন আগের তুলনায় অনেক কঠোর করা হয়। বাল্য বিবাহ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে বহুবিবাহের প্রচলন বৃদ্ধি পায়। পণপ্রথার প্রসার ঘটে। নারীদের ক্ষেত্রে অবশ্য একটি বিবাহ প্রচলিত হয়, আর বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ হয়।
চতুর্থত, খাদ্য, পানীয় বা পোশাক পূর্ববর্তী যুগের মতোই ছিল। তবে এসবের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তনগুলি আসে সেগুলি হল, গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ করা,পোষাক তৈরীর উপাদান হিসেবে তুলা ও প্রসঙ্গে এ যুগে রেশম যুক্ত হয়, এই যুগে জুতো, চিরুনি , আয়না ব্যবহারের কথা জানা যায়, এযুগে অবসর বিনোদনের ক্ষেত্রে কিছু নতুন উপকরণ যাথা কাব্য নাটকের প্রচলন শুরু হয়।
পূর্ববর্তী বৈদিক যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা:-
বহির্ভারতের যাযাবর আর্যরাই ভারতে গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতা সৃষ্টি করেছিলেন। পশুচারণ ও কৃষিকার্য ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন।তবে প্রথম স্তরে জমি ব্যক্তিগত সম্পত্তি রূপে গণ্য ছিল না। গৃহপালিত পশুর মধ্যে ঘোড়া, গরু, ছাগল, ভেড়া, কুকুর ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য। গরু ছিল সম্পদ নির্ধারণের পশু। তাই একে ‘গোধন’ বলা হত। কৃষির উন্নতির জন্য কূপ ও শেষ ব্যবস্থা ছিল। কৃষিকার্যের জন্য বৈদিক যুগে সপ্তসিন্ধুর জল নিয়ে দলাদলি ও বিবাদ হত।
পশুপালন ও কৃষি ছাড়াও ঋক বৈদিক আর্যদের অর্থনৈতিক ভিত্তি শিল্প ও বানিজ্য ক্ষেত্রে প্রসার লাভ করে। কালের গতির সঙ্গে সে যুগের জীবনযাত্রায় বিশেষ পরিবর্তন আসে। পোশাক-পরিচ্ছদ, কাষ্ঠ নির্মিত সামগ্রী, ধাতু নির্মিত অস্ত্রশস্ত্র ও দৈনন্দিন কর্মের হাতিয়ার বা যন্ত্রপাতি, অলংকার, বাসনপত্র, পোড়ামাটির সামগ্রীর চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। ফলে শিল্পে দক্ষ কারিগর থেকে নানা প্রকার শিল্পী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় (যেমন- সূত্রধর, চর্মকার, তাঁতি, কুম্ভকার ধাতু শিল্পী ইত্যাদি) সমাজে সূত্রধরের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ধাতুর মধ্যে সোনা, তামা ও ব্রোঞ্জের ব্যবহার বেশি হত।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও মুদ্রা:-
ঋকবেদে অনার্য পনি নামে একশ্রেণীর লোকের কথা উল্লেখ আছে, যারা ব্যবসা-বাণিজ্যে দক্ষ ছিল। আর্যরাও পরবর্তীকালে কৃষির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিযুক্ত হয়। প্রথমদিকে স্থানীয়ভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্রপাত হয়। এজন্য নদীপথ এবং স্থলপথ দুই-ই ব্যবহার করা হত। ঋকবেদে সমুদ্র ও সামুদ্রিক শব্দের উল্লেখ আছে। অনুমান করা হয় যে, আর্যরা সমুদ্রপথের সাহায্যে সামুদ্রিক বাণিজ্যের সঙ্গেও পরিচিত ছিল। তবে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। ঋক বৈদিক যুগে মুদ্রা ভিত্তিক অর্থনীতির প্রচলন ছিল না। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বৈদিক সাহিত্যে গোধন ছাড়াও ‘নিম্ক’ ও ‘মনা’ নামে ঋণ খন্ডের কথা উল্লেখ আছে। তবে এর ব্যবহার ছিল সীমিত। পণ্যের বিনিময় আদান-প্রদান ছিল সাধারণ রীতি।
পরবর্তী বৈদিক যুগের অর্থনীতি:-
প্রধানত অথর্ববেদ এবং উপনিষদ থেকে পরবর্তী বৈদিক যুগের অর্থনৈতিক জীবনের একটি পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়। পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যদের অর্থনৈতিক জীবনধারার ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন আসে। ঋক বৈদিক যুগের তুলনায় এযুগের অর্থব্যবস্থা অনেক বেশি পরিণত ও উন্নত। এযুগে বেশিরভাগ লোক গ্রামে বাস করত। তবে শেষের দিকে নগরের সূত্রপাত ঘটেছিল। কাশি, কৌশাম্বী বিদেহ, মগধ প্রভৃতি নগরের পরিচয় পরবর্তী বৈদিক যুগে পাওয়া যায়।
কৃষি ও পশুপালন:-
এযুগেও আর্যদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। তবে কৃষিকাজ ছাড়াও এ যুগের অর্থনৈতিক অবস্থায় পশুপালনও জীবিকার এক অঙ্গ ছিল। পশুর মধ্যে গরুর স্থান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী যুগের তুলনায় এ যুগে চাষের উন্নতি হয়, সারের ব্যবহার বৃদ্ধি পায় এবং উন্নত বীজ বপনের নিয়ম চালু হয়। প্রধান শস্যের মধ্যে ধান ও জবের সঙ্গে গম যুক্ত হয়েছিল। এযুগে জমি চাষের ক্ষেত্রে লাঙ্গলের আয়তন ও ওজনে পরিবর্তন আসে। কৃষিকাজে বলদ ছাড়া মহিষকেও ব্যবহার করা হত। ঋতুচক্র সম্পর্কে তখনকার কৃষকদের স্পষ্ট ধারণা ছিল। পরবর্তী বৈদিক যুগে জমির মালিকানা ছিল পরিবারগুলির হাতে। তাই এক একটা পরিবারের অধিকৃত জমির ফসলের উপর আর্থিক সচ্ছলতা নির্ভর করত।
শিল্প ও বাণিজ্য:-
কৃষি ও পশুপালন ছাড়াও পরবর্তী বৈদিক যুগে সূক্ষ্ম ও ভারী শিল্পের উন্নতি ও অর্থনৈতিক বিচারের একটি লক্ষনীয় বিষয়। শিল্পের ক্ষেত্রে এই যুগ বৈচিত্র এবং বিশেষ কারিগরি দক্ষতার দ্বারা চিহ্নিত ছিল। এই যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি ও সম্প্রসারণ ঘটেছিল। অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য দুই-ই প্রচলিত ছিল। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ‘শ্রেষ্ঠিণ’ অর্থাৎ ধনী ব্যবসায়ীর উল্লেখ আছে। সে যুগের বণিকরা মিলিত ভাবে ‘গণ’ বা সংঘ (Guild) স্থাপন করেছিল। এযুগেই ব্যবসা বাণিজ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বংশানুক্রমিক হয়ে দাঁড়ায়। সতপথ ব্রাহ্মণে এই যুগে বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমুদ্রযাত্রার কথা জানা যায়। মেসোপটেমিয়া ও অন্যান্য পশ্চিম এশিয়ার দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল বলে অনুমান করা হয়।
ধাতব মুদ্রা বলতে ঠিক যা বোঝায়, সে যুগে তার প্রচলন হয়তো ছিল না। সতপথ ব্রাহ্মণে ‘কুসীদিন’ ও তৈত্তিরীয়’ সংহিতায় ‘কুসীদ’ শব্দের ব্যবহার থেকে বোঝা যায় যে সেযুগে ঋণ প্রথা ছিল। তবে ঋণ দেওয়া নেওয়ার কাজ খুব সম্ভবত চলত দ্রব্যে, মুদ্রায় নয়।