প্রশ্ন ঃ- হরপ্পা বাসিদের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে কি জান ?
অথবা, সিন্ধু সভ্যতার ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে কি জান ?
অথবা, সিন্ধুযুগের বা হরপ্পাযুগের ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে কি জান?
অথবা, হরপ্পা অধিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতির পরিচয় দাও।
উত্তরঃ-
হরপ্পা বাসীর ধর্ম কেমন ছিল তা নির্দিষ্ট ভাবে বলা কঠিন কারণ, এ ব্যাপারে তথ্য খুবই অপ্রতুল। কোন মন্দির বা অন্য কোনো ধর্মীয় স্মৃতিচিহ্ন হরপ্পা অঞ্চলে পাওয়া যায়নি। ফলে হরপ্পা সংস্কৃতি ধর্ম সম্পর্কে আমরা মূলত: বিভিন্ন সিলমোহর, নারী মূর্তি ও প্রস্তর মূর্তির উপর নির্ভরশীল।
খনন কার্যের ফলে পোড়ামাটির তৈরি বহু নারী মূর্তি পাওয়া গেছে। এ থেকে অনুমান করা যায় যে হরপ্পা সভ্যতায় মাতৃ পূজার প্রচলন ছিল। দেবী মূর্তিগুলি ভারতীয় শক্তি সাধনার পরিচয় বহন করে।সম্ভবত এই মূর্তি গুলির সামনে ভক্তরা পূজার সময় ধুপ আর প্রদীপ জ্বালাত। কারণ কয়েকটি মূর্তির গায়ে ধোয়ার চিহ্ন অতিশয় সুস্পষ্ট। হরপ্পা সভ্যতায় আবিষ্কৃত সিলমোহর গুলিতে অঙ্কিত মূর্তিগুলি থেকেও হরপ্পা প্রবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সিন্ধু উপত্যকার মাতৃকা পূজা প্রসঙ্গে হরপ্পায় পাওয়া একটি সিলমোহরের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। এই সিলমোহরে উত্থানপাদ ভঙ্গিতে এক নগ্ন নারী মূর্তি অঙ্কিত রয়েছে, যার গর্ভ থেকে নির্গত হয়েছে কয়েকটি চারাগাছ। মনে হয় এখানে চারাগাছটির মধ্য দিয়ে দেবীর সৃষ্টি লীলা প্রকটিত হয়েছে। সৃষ্টির জননী রূপেই দেবীর আরাধনা হত। ঐ সিলমোহরের অপরদিকে আরেকটি দেবী মূর্তির সামনে নরবলির চিহ্ন উৎকীর্ণ। সম্ভবত তুষ্টির জন্য বলিদান করা হত।
হরপ্পা সভ্যতায় পুরুষ দেবতারও নিদর্শন পাওয়া যায়। পুরুষ দেবতার মধ্যে মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত সিলে জীবজন্তু বেষ্টিত, পদ্মাসনে উপবিষ্ট, তিন শৃঙ্গ বিশিষ্ট চক্ষু মুদ্রিত এক ধ্যানমগ্ন যোগী পুরুষকে স্যার জন মার্শাল ( Sir Jhon Marshall) আদি শিব (Proto Shiva) বলে বর্ণনা করেছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হরপ্পা অঞ্চলে শুধুমাত্র মূর্তির মাধ্যমেই দেবতার পূজা হত না। লিঙ্গ পুজাও প্রচলিত ছিল। সিন্ধু উপত্যকা লিঙ্গ ও যোনি আকারের পাথরের জিনিস প্রচুর পাওয়া গেছে। সম্ভবত এগুলি উপাসনার বস্তু ছিল। খুব সম্ভবত প্রজনন শক্তির প্রতীক রূপেই লিঙ্গ ও যোনির পূজা করা হত।
সিলমোহর গুলিতে বিভিন্ন জন্তুর মূর্তি দেখে মনে হয় পশুর পূজাও তাদের ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ ছিল।অনুমান করা যায় যে জীব জন্তুর মধ্যে কুঁজ বিশিষ্ট ষাঁড়ের পূজা প্রচলন ছিল। সবচেয়ে বেশ। এছাড়াও প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক হিসেবে বৃক্ষ, অগ্নি ও জল পূজার প্রচলন ছিল বলে মনে করা হয়। বৃক্ষের মধ্যে অশ্বত্থ বৃক্ষ কে পবিত্র বলে মনে করা হয়েছে। হরপ্পায় ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে ‘স্বস্তিকা‘ চিহ্নের ব্যবহার সূর্য পূজার ইঙ্গিত বহন করে। মহেঞ্জোদারোয় বৃহদায়তন স্নানাগারটি সম্ভবত ধর্মীয় স্নানের ইঙ্গিত বহন করে। সম্ভবত হরপ্পা বাসীরা ভৌতিক ও অশুভ শক্তিকে বিশ্বাস করত, সেজন্য তারা কবচ ধারণ করতো। প্রমাণ স্বরূপ ধ্বংসাবশেষের মধ্যে অনেক কবচ আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রচলিত এই ধর্ম ব্যবস্থা থেকে মনে হয় যে সৃষ্টির মূলে পুরুষ ও স্ত্রী আদর্শের সংযোগ এবং যোগ সাধনা এই ধর্ম ব্যবস্থার মূলে কাজ করেছিল।
মৃতদেহগুলিকে সমাধিস্থ করার রীতি ছিল।বিভিন্ন খনন কেন্দ্রে প্রাপ্ত সমাধি থেকে বোঝা যায় যে, সাধারণত তিন ধরনের সমাধির প্রচলন তখন ছিল যেমন -i) সম্পূর্ণ কবর। ii) আংশিক কবর। iii) মৃতদেহ ভূষ্মিভূত করে তা একটি আঁধারে ভরে কবরস্থ করা হয়। মৃতদেহ কে সাধারণত কবরস্থানের উত্তর থেকে দক্ষিনে শায়িত করা হত। সম্ভবত হরপ্পার লোকেরা পরলোকে বিশ্বাস করত। তবে হরপ্পা বাসীর লিপির পাঠোদ্ধার না করা পর্যন্ত তাদের ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে সঠিক কিছু বলা অসম্ভব।