নারায়ণ বংশের মুদ্রা | কোচবিহারের ইতিহাস PDF
কোনো দেশের অর্থৈতিক, রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ও অর্থনৈতিক বিনিময় ব্যাবস্থা জানার জন্য মুদ্রার ভূমিকা অপরিসীম। ভারতবর্ষে অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় প্রাগজ্যোতিষ কোচবিহার রাজ্যে মুদ্রার ব্যাবহার কোন সময় থেকে আরম্ভ হয় তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। সম্ভবত খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক থেকেই বাংলা ও কামরূপ রাজ্যে মুর্দার প্রচলন শুরু হয়। ভারতীয় মৌর্য, কুষাণ এবং গুপ্তরাজাগণ বঙ্গে যে মুদ্রার প্রচলন করেন তা কোচবিহার রাজেও প্রচলিত হয়। কোচবিহার রাজ্যে গুপ্ত পরবর্তী হুনরাজাদের মুদ্রাও আবিষ্কার হয়। সমসাম়িক ইতিহাস পরিলক্ষিত করলে (খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী) দেখা যায় যে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের কেহ কেহ কামরূপের ওপর সমসাময়িক আধিপত্য স্থাপন করলেও তাদের মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়নি। বঙ্গীয় মুসলমান শাসকদের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন ইউইয়াজ এবং তার পরবর্তী সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের মুদ্রাও নিদর্শনও কোচবিহার রাজ্যের কামতাপুর (গোসানীমারি) অঞ্চলে মিলেছে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মুসলমান শাসকগণ কোচবিহার রাজ্যে তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করলেও তাদের প্রচলিত কোনো মুদ্রার প্রমাণ মেলেনি।
নারায়ণী মুদ্রা
ইলিয়াস শাহ, হোসেন শাহের পরবর্তী সময়ে বিশ্ব সিংহ কোচবিহার রাজ্যের সিংহাসনে বসলে তিনিই প্রথম স্বনামে মুদ্রার প্রচলন শুরু করেন। এবং সেখান থেকেই এই রাজ্যের নরপতিগনের মধ্যে স্বনামে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয় এবং নরপতিগণ বংশ পরম্পরায় নিজ নামের শেষে নারায়ণ লেখার জন্যে তাদের প্রচলিত মুদ্র নারায়ণী মুদ্রা নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে নারায়ণী মুদ্রা নামকরণের পেছনে ওপর একটি কারণ হল এই রাজ্যের সকল নরপতিগণ কামতেশ্বরি দেবী ও ভগবান বিষ্ণু এই রাজ্যের কুলদেবতা। বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ সহ আলমগীরনামা ইত্যাদিতেও এই মুদ্রার উল্লেখ আছে। এই মুদ্রার আরো একটি নাম ছিল , তাহল শিবটঙ্ক বা শিবাঙ্কটঙ্ক। কারণ , এই মুদ্রা বা টাকার গাত্রে শিব, শিবদুর্গা মূর্তি বা নাম খোদিত ছিল।
বিশ্বসিংহ কোনরূপ মুদ্রার প্রচলন করেছেন কিনা তা সঠিক ভাবে জানা যায় না। তবে ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বসিংহ কর্তিক অহমরাজাকে তবে কোনো কোনো কুলজী উপহার প্রদানের বিবরণ রুদ্র সিংহের বুরুঙ্গিতে লিপিবদ্ধ আছে, কিন্তু তাতে কোনো মুদ্রার উল্লেখ নেই। বিশ্বসিংহের পুত্র মহারাজ নররায়নের মুদ্রার প্রমাণ মিলেছে। এশিয়াটিক সোসাইটির কার্যবিবরণীতে প্রথমসংখক টাকার নকশা মুদ্রিত হয়েছিল। বিশ্বসিংহের পুত্র নরনারায়ণের সময় থেকে নিয়মিতভাবে যে টাকা তৈরি করেছিলেন তা ছিল রূপার এবং তনখার ন্যায় দেখতে। সেই মুদ্রার ওজন ছিল প্রায় ১৬৫ গ্রেণ ও গোলাকার। তবে স্বর্ণ, রৌপ্য, পীতল এবং তামার মুদ্রার প্রচলন ছিল বলে জানা গেলেও এখন পর্যন্ত সেইরূপ কোনো মুদ্রা পাওয়া যায়নি।
নরণারায়নের পুত্র লক্ষীনারায়নের মুদ্রা কোচবিহার এর বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া গেছে। রাজাদের নামে নারায়ণ শব্দের ন অক্ষরের নিচে মনোগ্রাম এবং ক্লিনফ্লয়েল চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। রাজা প্রাণনারায়ণ ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দের একটি মুদ্রায় বিন্দু চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া কোন কোন মুদ্রায় ঢেঁরা ও অর্ধচন্দ্র বা চন্দ্রবিন্দু ইত্যাদি চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণ ও হরেন্দ্রনারায়ণ ছাড়া অন্য কোন রাজার টাকায় এধরনের চিহ্ন দেখা যায় না। কোচরাজাদের আগে কোচবিহারে খেন রাজারা রাজত্ব করতেন। সেই বংশের শেষ রাজা নীলাম্বরকে হারিয়ে হোসেন শাহ কামতা রাজ্য অধিকার করেছিল। এইসকল খেন রাজাদের কোন মুদ্রা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি । তবে তাঁদেরও মুদ্রা ছিল বলে মনে হয়। রাজপাটে কাছে টাঁকশাল নামক স্থানে যে সমস্ত প্রস্তরখন্ড পড়ে থাকতে দেখা যায় সেখানে রাজাদের তৈরি কিছু মুদ্রা পাওয়া যাবে এ ধরনের অনুমান অনেকেই করে থাকেন।
কোচবিহারের যে সমস্ত মুদ্রা পাওয়া যায় সেখানে মূর্তি মুদ্রিত নেই। এদের সোজা ও উল্টো দিকে শুধু সংস্কৃত ভাষায় ও বাংলা অক্ষরে লেখন থাকত।
সম্মুখভাগে —- শ্রীশ্রীজয়নত
পৃষ্ঠদেশে——-
তারিখ মুদ্রিত হতে দেখা যায় । এইরীতি নরনারায়ণের পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণের রাজত্বের কিছু সময় অবধি প্রচলিত ছিল । পরবর্তীকালে , কোচবিহারের পশ্চিমাংশ মোঘলদের অধিকারে চলে গেলে, রাজারা পুরো টাকা তৈরীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে কেবলমাত্র *আধুলি তৈরীর অনুমতি পান। ৩০০০০ আধুলি তৈরি হয়েছিল। সে সময় একটি রূপার আধুলিতে প্রায় ১/৪০ ভাগ তামা মেশানো হতো। ১০০ টি সিক্কার বদলে ১১৫ – ১১৯ টি নারায়ণী মুদ্রা পাওয়া যেত।
নরনারায়ণের সময় থেকেই নারায়ণী মুদ্রা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই নারায়ণী মুদ্রার চাহিদা ক্রমশ সমগ্র পূর্ব এবং উত্তর পূর্ব ভারতের প্রায় সব কটি রাজ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। জয়ন্তিয়া, কাছাড়, ডিমরুয়া ইত্যাদি অঞ্চলের রাজারা নারায়ণী মুদ্রার অনুকরণে মুদ্রা নির্মাণ করতে থাকেন। ভুটান এবং আসামের মানুষদের নিকট এই টাকার চাহিদা এবং জনপ্রিয়তা ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। এই সময় অনেক অসাধু লোক পাইকারী হারে নারায়ণী মুদ্রা তৈরি করে গোপনে অন্য রাজ্যে চালান দেবার চেষ্টাও করেছিল।
কোচবিহার সহ সম্পূর্ণ পূর্ব ভারতে ব্রিটিশ শাসন কায়েম করে। ব্রিটিশ কোম্পানি নারায়ণী মুদ্রা ব্যাবহারে অসম্মতি জানায় । ব্রিটিশ সরকার ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ শে ডিসেম্ব ২৯৬৯ নং পত্রে তাকসাল বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। । রাজা নৃপেন্দ্র নারায়নের অনুরোধে কর্নেল হটন একপ্রান্তে রাজা ও অপর প্রান্তে ইংল্যান্ডের রানীর মূর্তি স্থাপন করার শর্তে নারায়ণী মুদ্রা প্রস্তুত করার জন্যে গভর্মেন্টর নিকট প্রস্তাপ পেরণ করলেও সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়নি ।
মহারাজ সিবেন্দ্রনারায়নের রাজ্জাভিসেককালে ১০০১ টি রূপার এবং কিছু সোনার আধুলি প্রস্তুত করা হয় । তার মধ্যে পাঁচটি সোনার মুদ্রা গভর্মেন্ট র নিকট পাঠায়। পরবর্তী কালে কোচবিহার রাজ্যের নরপতিগণ রাজ্জাভিসেক কালে স্বনামে কিছু মুদ্রা প্রস্তুত করলেও সেগুলি প্রচলিত বলে গণ্য হয়নি। এ সত্বেও কোচরাজাদের নারায়ণী মুদ্রা কামতা রাজ্যের রাজ্যবাসীর কাছে অনেক আদরের অনেকাংশে এই মুদ্রা লক্ষী পুরেও গণ্য । নারায়ণী মুদ্রা কোচবিহার বাসীকে গর্বিত করে।
নারায়ণ বংশের মুদ্রা | কোচবিহারের ইতিহাস PDF
।। আগ্রহী লেখকদের আহ্বান।। আপনাদের মূল্যবান লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের। যেকোনোও সময়, যেকোনও দিন। আমরা প্রকাশ করবো।
বিষয়:-
বিজ্ঞানের আবিষ্কার,চলচ্চিত্র, খেলাধুলা, সভা-সমিতি, মনীষীদের জীবন, ধর্মান্ধতা, সামাজিক সংকট, কুসংস্কার বিরোধী, পলিটিক্যাল স্ক্যাম, পলিটিক্যাল ইস্যু, পলিটিক্যাল টেরোরিজম, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এমন যেকোন বিষয়েই লেখা পাঠানো যাবে।
নির্দিষ্ট কোন শব্দ সীমা নেই।
WhatsApp করে লেখা পাঠান:- 8116447650
…. প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন আমাদের WhatsApp নম্বরে …