‘বাবার হইল আবার জ্বর সারিল ঔষধে’
বাবার হইল আবার জ্বর সারিল ঔষধে’— ছোটবেলায় শেখা প্রতাপশালী মুঘল সম্রাটদের নাম ধারাবাহিকভাবে মনে রাখার সূত্র। অনেকের যেমন অঙ্কের নাম শুনলেই গায়ে জ্বর আসে, তেমনই বহু মানুষের কাছে শাসকের নামধাম আর সাল–তারিখের গোলকধাঁধা ইতিহাস বিষয়টাকেও দুরধিগম্য করে তোলে। কিন্তু ইতিহাস মানে কি কেবল নাম, ধাম আর সাল–তারিখ? একেবারেই না। কীভাবে এই বিষয়ে গড়ে তোলা যায় আকর্ষণীয় কেরিয়ার, জানাচ্ছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. শৌভিক মুখোপাধ্যায়।
‘বাবার হইল আবার জ্বর সারিল ঔষধে’— ছোটবেলায় শেখা প্রতাপশালী মুঘল সম্রাটদের নাম ধারাবাহিকভাবে মনে রাখার সূত্র। অনেকের যেমন অঙ্কের নাম শুনলেই গায়ে জ্বর আসে, তেমনই বহু মানুষের কাছে শাসকের নামধাম আর সাল–তারিখের গোলকধাঁধা ইতিহাস বিষয়টাকেও দুরধিগম্য করে তোলে। কিন্তু ইতিহাস মানে কি কেবল নাম, ধাম আর সাল–তারিখ? ইতিহাস— ‘ইতি হ–আস’ মানে অতীতে যেমটা ঘটেছিল, কিন্তু কেবলমাত্র রাজায় রাজায় যুদ্ধের বিবরণ নয়। পৃথিবীতে হেন কোনও জিনিস নেই যা ইতিহাসের আলোচ্য নয়! মজার হলেও ব্যাপারটা এইরকম যে, পদার্থবিদ্যারও ইতিহাস আছে, অঙ্কেরও ইতিহাস রয়েছে, যদিও একইভাবে ইতিহাসের পদার্থবিদ্যা নেই! আর তাই পড়াশোনা, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে ইতিহাস এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অতি দর্পে হত লঙ্কা, অতি মানে চ কৌরবা, অতি দানে বলির বদ্ধ, সর্বম অত্যন্ত গর্হিতম
‘‘This too much bad, if passongers go to make dung, the damn guard not wait train five minutes for him?’’
কী পড়ব?
এক কথায় ইতিহাস সময়ের সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি— সমাজ সংস্থান এমনকি ব্যক্তির জীবনেও যে পরিবর্তন ঘটেছে, তার সালতামামি এবং সেই পরিবর্তনের কারণগুলি অনুসন্ধান করে। ধরা যাক ভারতীয় রেলে ট্রেনগুলোতে টয়লেট কবে থেকে চালু হল, কেন হল, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক মজার গল্প। ১৯০৯ সালের ২ জুলাই জনৈক অখিলচন্দ্র সেন প্রচুর কাঁঠাল খেয়ে ট্রেনে চড়েন এবং আহমদপুর স্টেশনে পৌঁছে পেটের বেগ সহ্য করতে না পেরে হালকা হতে স্টেশনে নামেন। এর মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দেয় এবং অখিলবাবু কাপড়ে চোপড়ে হয়ে স্টেশনে পড়ে থাকেন। রেল আধিকারিককে লেখা চিঠিতে অখিলবাবু তাঁর এই হেনস্থার জন্য বেআক্কেলে গার্ডের শাস্তির আবেদন করেন এভাবে— ‘‘This too much bad, if passongers go to make dung, the damn guard not wait train five minutes for him?’’ (মূল চিঠির বানান ও ভাষা অপরিবর্তিত) এই বিচিত্র পরিস্থিতি এবং তার নথিস্বরূপ এই চিঠির কল্যাণেই রেলগাড়িতে টয়লেটের ব্যবস্থা হয়, নইলে আরও কতদিন অপেক্ষা করতে হত কে জানে! ট্রেনযাত্রার ইতিহাসে অখ্যাত অখিলচন্দ্র সেনের এই বিখ্যাত চিঠির মতো গল্প হলেও সত্যি অমূল্য মণিমুক্তো ঐতিহাসিকের জহুরির চোখ (বা সত্যান্বেষী বোমকেশ বক্সির চোখ) খুঁজে বের করে। একদিকে সত্যান্বেষীর আতসকাচ, অন্যদিকে সেই দাস্তান বর্ণনা করার নিপুণ সাহিত্যিক দক্ষতা তাই ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেককেই বিখ্যাত করে তুলেছে। হাল আমলের বেস্ট সেলারগুলোর মধ্যে অনেকটা (বিশেষত নন–ফিকশন) ঐতিহাসিকদের লেখা। রামচন্দ্র গুহ বা উইলিয়াম ডালরিম্পল, হাতের কাছে উদাহরণের অভাব নেই।
কোথায় পড়ব?
পেশার কারণে আমায় পড়াতে হয় ভারতের প্রাচীনতম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৫৭ সালে তৈরি হওয়ার সময় আফগানিস্তানের সীমানা থেকে ব্রহ্মদেশের সীমান্ত ছিল তার কর্মক্ষেত্র। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে ইতিহাস পড়ানো শুরু ১৯১২ সাল থেকে। সেই হিসাবে আমাদের ইতিহাস বিভাগের বয়স ১১০ বছর ছাড়িয়েছে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলিতে স্নাতকস্তরে যাদবপুর বা বিশ্বভারতীর মতো একক (ইউনিটারি) বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে ইতিহাস, কোথাও কোথাও প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং প্রত্নতত্ত্ব (যেমন– বিশ্বভারতী) পড়ানোর ব্যবস্থা আছে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় বা হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রচুর সুনাম। আর এখন ইন্টারনেটের দৌলতে ইতিহাস কোথায় পড়ব এই প্রশ্নের হাজার হাজার একটা উত্তর রয়েছে, ধৈর্য ধরে খুঁজে হবে এই যা।
পড়ে কী হবে?
ইতিহাস সবার হাঁড়ির খোঁজ রাখলেও সে নিজে সেই হাঁড়ির মালিক নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান/শাস্ত্রের ইতিহাসচর্চা করে কেউ ডাক্তার হয় না, তবে ১৯১৯ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর ইতিহাসচর্চা করলে কোভিডজনিত প্রতিক্রিয়া বুঝতে সুবিধা হয় বইকি। ইতিহাস পড়ে সবাই ইতিহাসচর্চাকে তার পেশা করবে এমনটা নয়। তবে গোড়ায় পেশাদার ঐতিহাসিকের কাজের ক্ষেত্রটা দেখে নেওয়া যাক। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ অবশ্যই ইতিহাসের স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা উচ্চতর শিক্ষাপ্রাপ্তদের কাজের একটা বড় জায়গা যেখানে তারা ভবিষ্যতের রমেশচন্দ্র মজুমদার, যদুনাথ সরকারদের লালনপালন করবে।
তবে এর পাশাপাশি ইতিহাসচর্চার মধ্য দিয়ে যে দক্ষতা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয় তার কিছু বিশেষ মূল্য রয়েছে। ইতিহাসের শিক্ষার্থী সাল–তারিখ মুখস্থের থেকেও বেশি বিভিন্ন নথি পরীক্ষা, তার সৃষ্টির প্রেক্ষাপট, নথির স্রষ্টার মানসিকতা, নথির সোচ্চার ও অনুচ্চার বক্তব্য অনুধাবনের শিক্ষা দেয়— যা দেশের পরিচালকমণ্ডলীর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৮২৬ সালে যখন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের (যার বর্তমান অবতার ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস) হবু আমলাদের জন্য প্রথমবার পরীক্ষা চালু হল, সেই পরীক্ষার প্রথম স্থানাধিকারী হেনরি মায়ার্স এলিয়ট নিজেই ছিলেন ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস রচনার আকর সংগ্রহের পুরোধা ব্যক্তি। স্বাধীন ভারতে প্রাচীন তামিল লিপি, লেখমালা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব ইরাবথম মহাদেবন ছিলেন পেশায় আইএএস অফিসার। ইতিহাসের লব্ধপ্রতিষ্ঠ ছাত্র, গবেষকরা অনেকেই প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। এর কারণ নথি বিশ্লেষণ এবং সেই বিশ্লেষণের ফলকে যুক্তিগ্রাহ্য ও মনোগ্রাহী রূপে উপস্থাপনের ক্ষমতা ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীদের অধিগত।
এর পাশাপাশি ইতিহাসচর্চার আকর সংরক্ষণ কেন্দ্র— মহাফেজখানা থেকে জাদুঘর অথবা প্রত্নতত্ত্বের বিভিন্ন প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সর্বেক্ষণ কেন্দ্রে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত পেশাদারদের কাজের সুযোগ রয়েছে। এখন অনেক কর্পোরেট সংস্থা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও তাদের নথি সংরক্ষণের জন্য মহাফেজখানা তৈরিতে আগ্রহী।
এছাড়া ইতিহাসের ব্যাপারে সার্বজনীন আগ্রহের কারণে পুরোদস্তুর লেখক বা উপস্থাপকের পেশা রইলই। প্রথম জীবনে রামচন্দ্র গুহ, নৃতত্ত্ব ইতিহাস নিয়ে গবেষণা, পড়ানোর কাজ করলেও এখন পুরোদস্তুর লেখাকেই পেশা করে নিয়েছেন। আবার এই ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ইউটিউবের কল্যাণে অনেক ইতিহাস আশ্রিত ইউটিউব চ্যানেল তৈরি হয়েছে— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার উপর হিটলারের আগ্রাসন— স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ নিয়ে চর্চা করা TIK-History Channel বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাস নিয়ে Mark Felton Production এমনই অসংখ্য উদ্যোগের মধ্যে উজ্জ্বল নিদর্শন।