কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র সম্পর্কে টীকা লেখ (Write a commentary on Kautilya’s Arthashastra)
অথবা,
অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা কে ছিলেন এর মূল বিষয়বস্তু কি ছিল (Who is the author of Arthashastra and what was its main content?)
অথবা,
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র (Write notes on Arthasastra of Kautilya.)
অথবা,
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র টিকা pdf
অথবা,
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র মৌর্যদের শাসন বেবস্থার উপর সর্বাপেক্ষা বৃহৎ একটি দলিল। (Arthasastra of Kautilya was the most comprehensive document about the administrative system of the Mauryas.)
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতে ‘ অর্থশাস্ত্র’ নামে একটি গ্রন্থ পাওয়া যায়। অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা সম্পর্কে মতভেদ আছে। শ্যামা শাস্ত্রী, গণপতি শাস্ত্রী, ভিনসেন্ট স্মিথ, জয়সোয়াল প্রমুখ ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে ‘ অর্থশাস্ত্রে’র প্রণেতা ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী চানক্য একই ব্যক্তি। অন্যদিকে কীথ, ভান্ডারকর প্রমুখ ঐতিহাসিকরা অর্থশাস্ত্র মোর্যযুগের অনেক পরে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রচিত হয়েছিল বলে মনে করেন। অর্থশাস্ত্রটি গদ্যে লেখা। এই গ্রন্থে আমরা প্রাচীন ভারতের উচ্চমানের রাজনৈতিক ধারণা সমন্ধে জানতে পারি। অনেকের মতে এই রাজনৈতিক গ্রন্থটির বেশির ভাগ অংশই পরবর্তীকালে সংকলিত হয়েছিল, তবে আলোচিত রাষ্ট্রনীতি সমন্ধে ধারণা ও নীতিসমূহ, মৌর্য যুগের ভাবনা-চিন্তারই প্রতিফলন।
‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে জানা যায় তখন ভারতে রাজবংশ শাসিত রাজ্যগুলির পাশাপাশি গণরাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল। তবে রাজা কর্তৃক শাসিত রাজ্যই ছিল প্রধান রাজনৈতিক প্ৰথা। রাষ্ট্রের তথা রাজার কর্তব্য সম্বন্ধে অর্থশাস্ত্রে যা বলা হয়েছে তা আজও সকল রাষ্ট্রের আদর্শ। কৌটিল্যের মতে ‘প্রজা সুখে সুখং রাজ্ঞ, প্ৰজানাং চ হিতে হিতম্’ (অর্থাৎ প্রজাদের সুখ রাজার সুখ, প্রজাদের মঙ্গল রাজার মঙ্গল)। আজকাল কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। এরূপ রাষ্ট্রের কাজ বা কর্তব্য অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত রাজা বা রাষ্ট্রের কর্তব্যের সঙ্গে কোন পার্থক্য নেই। অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে রাজার দায়িত্ব ছিল তাঁর প্রজাবর্গকে রক্ষা করা। এ কারণে দোষীর শাস্তিদান তাঁর রাজকার্যের অঙ্গ।
কৌটিল্যের মতে সবচেয়ে বিপজ্জনক ধরনের অশান্তি হ’ল আভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ বা অভ্যুত্থান। কৌটিল্য রাজাকে সম্বোধন করে লিখেছেন যে আভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ বহিঃশত্রুর আক্রমণের চেয়ে ভয়ঙ্কর। কারণ এর দ্বারা জনসাধারণের মধ্যে অবিশ্বাসের মনোভাব গড়ে ওঠে। উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের ওপর বিশেষ নজর রাখবার জন্য কৌটিল্য রাজাকে গুপ্তচর নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন।
কৌটিল্য বৈষয়িক স্বার্থকেই সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন। এই স্বার্থরক্ষার জন্য ঐতিহ্য বা প্রাচীন বিধিবিধান না মানলেও চলবে বলে মত দিয়েছেন। সরকারী নির্দেশের ওপরে কিছু নেই বলে তিনি মনে করতেন। আর্থিক দুরবস্থা থেকে রাজ্যকে উদ্ধারের জন্য তিনি এমন কি মন্দিরের অর্থ ও সম্পত্তি কেড়ে নেবার পরামর্শ দিয়েছেন।
অর্থশাস্ত্রে ভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের কথা, যুদ্ধ পরিচালনা ও শান্তি স্থাপনের নীতি ও পদ্ধতি সম্বন্ধে বলা হয়েছে। অর্থশাস্ত্রে বৈদেশিক নীতি পরিচালনার ছয়টি নীতি বা পদ্ধতি উল্লেখ আছে। যেমন, শান্তি, যুদ্ধ, পর্যবেক্ষণ ও প্রতীক্ষা, আগ্রাসন, প্রতিরক্ষার উপায়াদি সন্ধান এবং কূটনীতি বা দুমুখো নীতি। রাষ্ট্রদূতদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে অর্থশাস্ত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কৌটিল্যের মতে রাষ্ট্রদূতদের কাজ হ’ল বন্ধুরাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিবাদ বাধিয়ে দেওয়া, গোপন ষড়যন্ত্র করা, মোতায়েন সৈন্যদের গোপনে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। অন্য রাজ আক্রমণ করার সবচেয়ে সুবিধাজনক পরিস্থিতি সম্বন্ধে কৌটিল্য লিখেছেন যে সম্ভাব্য শত্রুদের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সে রাজ্যে রাজার সঙ্গে প্রজাদের সম্পর্ক সম্বন্ধে ভালোভাবে জানতে হবে। অর্থাৎ যে রাজ্যের রাজার বিরুদ্ধে প্রজাদের অসন্তোষ ধূমায়িত সে রাজ্য আগে আক্রমণ করা উচিত বলে কৌটিল্য মনে করতেন।
রাজ্যের শাসনব্যবস্থা সম্বন্ধে কৌটিল্য খুঁটিনাটিভাবে উল্লেখ করেছেন। রাজার ক্ষমতা, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসন, বিচারব্যবস্থা, সামরিক বিভাগ, রাজস্ব প্রভৃতি কোনটিই তিনি বাদ দেননি। অর্থশাস্ত্রে এগুলি সম্বন্ধে বিস্তৃতভাবে বলা হয়েছে। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে এও উল্লেখ করেছেন যে ক্ষত্রিয়দের শক্তি ব্রাহ্মণদের মন্ত্রণায় চালিত হ’লে তা অজেয় হয়ে ওঠে এবং চিরকাল অজেয় থাকে। অর্থশাস্ত্রে দাসপ্রথা সম্বন্ধে উল্লেখ আছে। স্থায়ী দাস ও অস্থায়ী দাসদের মধ্যে তিনি পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। অস্থায়ী দাসদের পুত্রকন্যারা দাস হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিভাবে দাস অবস্থা থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে তার উল্লেখও অর্থশাস্ত্রে আছে। এমনও কি অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে ক্রীতদাসদের নিজস্ব সম্পত্তি রাখার অধিকার আছে।
কৌটিল্য দর্শনশাস্ত্র, বেদপাঠ, অর্থনীতিশাস্ত্র পাঠ ও রাষ্ট্রশাসন সম্পর্কিত পাঠ (দন্ডনীতি) গ্রহণকে জ্ঞানের প্রধান শাখা বলে মনে করতেন। দর্শনশাস্ত্রকে তিনি জ্ঞানবিজ্ঞানের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে ধরেছিলেন। তাঁর মতে দর্শনশাস্ত্রে অধিকার থাকলে রাজ্যশাসন ভালোভাবে করা যায়। এদিক থেকে প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিক প্লেটোর ‘দার্শনিক রাজ’ (Philosopher King) চিন্তাধারার সঙ্গে তাঁর অনেক মিল আছে।
প্রাচীন ভারতের চিন্তাজগতে ‘অর্থশাস্ত্র’ একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কস্বরূপ। এই গ্রন্থ ভারতের রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে প্রাচীন গ্রীসের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে সম-মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। কৌটিল্যকে একদিকে প্রাচীন গ্রীসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ আরিষ্টটল ও ইটালীর রেনেসাস যুগের মেকিয়াভেলির সঙ্গে সমান আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।