[New] ভারতে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য বর্তমান [Unity in diversity exists in India] | ভারতে বৈচিত্র | Nana Ronger Itihas। PDF [Download]

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now

 


ভারতে বৈচিত্র
ভারতে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য বর্তমান
“ভারতে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য বর্তমান।” – মন্তব্যটির যথার্থতা আলোচনা করো।





উত্তর:


ভারতের বৈচিত্র:


ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যা সর্বপ্রথমে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল এই দেশের অফুরন্ত ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র। ভূপ্রকৃতি গঠন ও জলবায়ুর বিভিন্নতা, জনসমষ্টির জাতিগত প্রকারভেদ, ধর্ম, ভাষা, রীতিনীতি ও সংস্কৃতির পার্থক্য লক্ষ্য করলে ভারতবর্ষকে মহাদেশ বলে মনে করা যেতে পারে।


জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য:


ভারতবর্ষের বিশাল বিস্তৃতি স্বাভাবিকভাবেই ভারতবর্ষের বিভিন্নতার সৃষ্টি করেছে। গৃষ্ম এবং শীতের প্রকোপ এক এক অঞ্চলে এক এক রূপ। অধিক বৃষ্টিপাত এবং বৃষ্টির স্বল্পতা উভয়ই ভারতের দেখতে পাওয়া যায়। উর্বর প্রান্তর এবং ঊষর মরুভূমি এই দুয়েরই অবস্থান একই দেশে। ভূ প্রকৃতির গঠনের ক্ষেত্রেও প্রচুর বিভিন্নতার নিদর্শন পাওয়া যায়।


জাতিগত ও ভাষাগত পার্থক্য:


ভারতবর্ষের অধিবাসীদের মধ্যে নানা প্রকার পার্থক্য দেখা যায়। কাশ্মীর থেকে কুমারিকা অন্তরীপ পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করলে ভারতের অধিবাসীদের আকৃতিগত প্রভেদ এবং গাত্রচর্মের তারতম্য সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ভারতে পৃথিবীর অধিকাংশ মানবগোষ্ঠীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বাসার ক্ষেত্রেও বিভিন্নতা যথেষ্ট। প্রধান ভাষাগুলি ছাড়াও আছে নানা প্রকারের উপভাষা জাতির সংখ্যা অগনিত। বিভেদ, সম্প্রদায়গত বিভেদ, এমনকি গোষ্ঠী ও গোত্র নিয়েও বিভেদ এদেশের মানুষের মধ্যে লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া হিন্দু সমাজের মধ্যে আছে জাতিভেদ প্রথা। নৈসর্গিক অবস্থার যেমন বৈচিত্র আছে তেমনি এদেশে বাস করে এমন বহু উপপ্রজাতি যাদের জীবনযাত্রা এখনও সভ্যতার আদিম স্তরকে অতিক্রম করতে পারে নি। সেই কারণেই এদেশের কোথাও কোথাও মানুষ এখনও শিকার করে কিংবা বন জঙ্গলের ফলমূল আহরণ করে জীবন ধারণ করে। আবার কোথাও চলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবিরত চর্চা ও সভ্যতার নতুন নতুন স্তরে উত্তরণ।


ধর্মগত প্রভেদ:


ভারতবর্ষে ক্রমাগত বৈচিত্র ও দেখতে পাওয়া যায়। ভারত বর্ষ হল বহু ধর্মের দেশ। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শী, মুসলমান, খ্রিষ্টান প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। তাছাড়া রয়েছে এখানকার আদি অধিবাসীদের নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি। এইসব বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে রয়েছে মৌলিক প্রভেদ।


রীতিনীতির পার্থক্য:


রীতি নীতির ক্ষেত্রে ভারতের বৈচিত্রের কোন অভাব নেই। বিবাহ ও অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার মধ্যে প্রভেদ সর্বাপেক্ষা স্পষ্ট। ভারতের অগণিত হিন্দুদের নিকট আজও বিবাহ একটি ধর্মগত অনুষ্ঠান বলে স্বীকৃত। অপরদিকে মুসলমান এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নিকট বিবাহ একটি চুক্তি ভিন্ন অন্য কিছুই নয়। হিন্দুদের অন্তোষ্টিক্রিয়া মুসলমান, খ্রিষ্টান ও পারসী অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রদ্ধতি থেকে পৃথক।



বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য:


এত বিভেদ এর মধ্যে ভারত ইতিহাসের মধ্যে একটি মূল ঐক্যের সূর চিরকালই বিরাজমান। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্নতা ও বিভেদ অপেক্ষা গভীরতর সত্য হল ঐক্য। (“India beyond all doubt processes a deep underlying fundamental unity, far more profound than that product by geographical isolation or political suzerainty. That unity transcends the innumerable diversities of blood, colour, language, dress, manner and sect.” – Vincent Smith)। ভারতবর্ষের ভৌগোলিক অবস্থান ভারতবর্ষকে একটি স্বতন্ত্র দেশের মর্যাদা দান করেছে। এই ভৌগলিক অখন্ডতাকে অতিক্রম করে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক অখন্ডতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতবর্ষের সভ্যতার মধ্যে এমন সকল বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা উপমহাদেশে সর্বত্র বিরাজ করছে। ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে একটি স্বতন্ত্র সত্তার সৃষ্টি হয়েছে।


ভারতভূমি সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ:


দেশ হিসেবে ভারতবর্ষ এক, এই ধরনের অতি প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয়গণ মনে করে এসেছে। কিংবদন্তিতে বলা হয়েছে যে, বৈদিক আর্য গোষ্ঠীগুলির অন্যতম ভারত গোষ্ঠীর নাম অনুসারে এই দেশের নাম হয়েছে ‘ভারতবর্ষ’। ‘বিষ্ণুপুরাণে’ বলা হয়েছে –


“উত্তরম্ যৎ সমুদ্রস্য হিমাদ্রেশ্চৈব দক্ষিণম্‌।

বর্ষম্ তদ্ ভারতম্ নাম ভারতী যত্র সন্ততিঃ।।”


অর্থাৎ – “সমুদ্রের উত্তর ও হিমালয়ের দক্ষিনে অবস্থিত দেশের নাম ভারত। সেখানে ভারতের সন্তানগণ বাস করেন।” এই কারণে ভারতবর্ষ বর্ণনায় প্রাচীন যুগে মুনি-ঋষিগণ কখনও বলেছেন ‘হিমবৎ-সেতু-পর্যন্ত্’, আবার কখনও ‘হিমবৎ-বিন্ধ্য-কুন্ডলা’ প্রভৃতি নামে ভূষিত করেছেন। ভারতবর্ষকে অতি প্রাচীনকাল  থেকে আজও ‘দেবনির্মিতম্ স্থানম্’  বলে শ্রদ্ধা করে আশা হচ্ছে। দেশ সম্পর্কে এই শ্রদ্ধাবোধ ভারতভূমির এই অখন্ডতাবোধকে জাগ্রত করে রেখেছে। সমগ্র দেশ সম্পর্কে চেতনা এবং অনুভূতি অতি প্রাচীনকালেই ভারতীয়দের মনে সৃষ্টি হয়েছিল।


বেদ ও অপরাপর প্রাচীন গ্রন্থ সম্পর্কে শ্রদ্ধা:


ভারতবর্ষের অধিকাংশ অধিবাসী হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত। হিন্দুদের মধ্যে অসংখ্য ভেদাভেদ থাকলেও বেদ সম্পর্কে প্রগাঢ়  শ্রদ্ধা সকলের মধ্যে দেখা যায়। উপনিষদ, গীতা ও বিভিন্ন সংগীতা সকলেরই নিকট পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বলে স্বীকৃত। রামায়ণ ও মহাভারতে ভারতের মর্মকথা বর্ণিত হয়েছে, তা সকলেরই সুদৃঢ় বিশ্বাস। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম আন্দোলন এই ঐক্যবোধকে কোন সময়েই দুর্বল করতে পারে নি; এমনকি লোকায়ত দর্শনের চিন্তা ও কর্মকান্ড ঐক্যবদ্ধের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে তুলতে পারে নি। পরিবর্তে ভারতের বিভিন্ন ধর্ম আন্দোলন এই ঐক্যবোধকে অধিকতর সুদৃঢ় করেছে।


ঐক্য সৃষ্টিতে সংস্কৃত ভাষার স্থান:


ভাষাগত দিক থেকে সংস্কৃত ভাষা ঐক্যবোধ সৃষ্টি করেছে। এই ভাষা দেবভাষা বলে বন্দিত হয়েছে। দেবভাষা চর্চার কেন্দ্র ভৌগলিক বিভিন্নতার প্রাচীর গুলিকে চূর্ণ করেছে। আবার ভারতের প্রায় সমস্ত প্রাদেশিক ভাষার মূল উৎস হল সংস্কৃত। এমনকি দক্ষিণ ভারতের প্রধান ভাষাগুলি যথা – তামিল, তেলেগু, কানাড়া ও মালায়ালাম ভাষার উপর সংস্কৃতের প্রভাব রয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উর্দু ভাষার কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। ব্যাকরণের দিক থেকে উর্দু ভাষা হিন্দি ভাষারই অনুরূপ কিন্তু লিপি এবং শব্দের উপর ফরাসি ভাষার প্রভাবই বেশি। অন্যদিকে সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত শব্দের স্থান উর্দু ভাষায় নেই একথাও বলা চলে না।


তীর্থক্ষেত্র ও তীর্থযাত্রা প্রথার অবদান:


হিন্দু তীর্থ যাত্রা প্রথাও অখন্ড ভারতের আদর্শকে বাস্তব রূপ দিয়েছে। ভারতের প্রতি অঞ্চলে নদ-নদী, হ্রদ-প্রস্রবণ, পর্বত ও সমুদ্রতীর পবিত্র তীর্থক্ষেত্র রূপে হিন্দুদের নিকট গণ্য হয়। ধর্মগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বিশাল দেশের প্রতি অংশে তার পবিত্র স্থান গুলি এই কারণে তীর্থ স্থানের তালিকা যেন ভারতের ভূগোলেরই এক একটি টি অধ্যায়। হিন্দুধর্ম ও আচার সর্বভারতীয় ঐক্যের ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত।


রাজনৈতিক ঐক্য- এর  আদর্শ:


রাজনৈতিক ঐক্য যদিও ভারতের ইতিহাসে অল্প কালের জন্য প্রতিষ্ঠিত থেকেছে তা সত্বেও রাজনৈতিক ঐক্যের আদর্শ অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় মনকে আকর্ষণ করেছে। বৈদিক সাহিত্য একরাট, সম্রাট, রাজ চক্রবর্তী প্রভৃতি রাজপদের উল্লেখ এবং অশ্বমেধ, রাজসূয় প্রভৃতি যজ্ঞানুষ্ঠান একটি প্রবল রাজশক্তির অধীনে দেশের বিভিন্ন অংশকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রমাণস্বরূপ। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ভারতবর্ষকে সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্র হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। অতি প্রাচীনকাল থেকেই রাজনৈতিক ঐক্যবোধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মৌর্য সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রভৃতি সাম্রাজ্যের উদ্ভব ঘটেছে এবং পরবর্তীকালে ভারত ইতিহাসকে নানান ভাবে প্রভাবিত করেছে।


ভারতবর্ষের পরবর্তীকালের ইতিহাস ঐক্য চেতনাকে খন্ডিত করে নি:


ভারতবর্ষে মুসলমান রাজশক্তির অভ্যুদয়ের পর ঐক্য সম্পর্কে পূর্বাভ্যস্ত চেতনা খন্ডিত হয় নি। আলাউদ্দিন খলজী ও ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে প্রায় সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ একটি কেন্দ্রীয় শক্তির অধীনে আসে। ভারতবর্ষের উপর দীর্ঘকাল এক শাসন প্রবর্তনের কৃতিত্বের অধিকারী হল ইংরেজরা। ইংরেজ শাসনের ফলে ভারতের বহু গুণগত ক্ষতি ঘটলেও এদেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ সকল মানুষের মনে ঐক্যবোধের চেতনা যে বৃদ্ধি পেয়েছিল সে সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।



জীবনাদর্শ সম্পর্কে সমদৃষ্টিভঙ্গির অবদান:


সর্বশেষ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আবহমানকাল ধরে ভারতবর্ষের জীবনাদর্শ সম্পর্কে সমদৃষ্টি। এই সমদৃষ্টি শুধুমাত্র প্রাচীন যুগে হিন্দু সমাজের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না। সমদৃষ্টিভঙ্গি জাতি, ভাষা ও সমাজের ব্যবধানকে অতিক্রম করে আজও নিজ মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, “ভারতবর্ষের চিরদিনই একমাত্র চেষ্টা দেখিতেছি প্রভেদের মধ্যে ঐক্যস্থাপন করা, নানা পথকে একই লক্ষ্যের অভিমুখীন করিয়া দেওয়া এবং বহুর মধ্যে এককে নিঃসংশয় রূপে অন্তরতমরূপে উপলব্ধি করা – বাইরে যে-সকল পার্থক্য প্রতীয়মান হয় তাহাকে নষ্ট না করিয়া তাহার ভিতরকার নিগূঢ় যোগকে অধিকার করা। …. ভারতবর্ষীয় সভ্যতা যে ঐক্যের আশ্রয় করিয়াছে তাহা মিলনমূলক।” সুতরাং ধর্ম, ভাষা ও আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যের  ঊর্ধ্বে উঠে ভারতবর্ষের মূলগত ঐক্যবোধ কীভাবে রক্ষিত হয়েছে তাই ভারত ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় বিষয়।

Leave a Reply