স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং বিপ্লবী শহীদ যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়- বাঘা যতীনের [Bagha Jatin] জন্মদিনে রক্তিম অভিবাদন

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now

স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং বিপ্লবী
শহীদ যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়- বাঘা যতীনের জন্মদিনে
রক্তিম অভিবাদন ,লাল সালাম।
(জন্মঃ-৭ ডিসেম্বর, ১৮৭৯ – মৃত্যুঃ- ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯১৫)
ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। বাঘা যতীন ছিলেন বাংলার প্রধান বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর দলের প্রধান নেতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে কলকাতায় জার্মান যুবরাজের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করে তিনি জার্মানি থেকে অস্ত্র ও রসদের প্রতিশ্রুতি অর্জন করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জার্মান প্লট তাঁরই মস্তিস্কপ্রসূত।
 
সশস্ত্র সংগ্রামের এক পর্যায়ে সম্মুখ যুদ্ধে উড়িষ্যার বালেশ্বরে তিনি গুরুতর আহত হন এবং বালাসোর হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করার পর তিনি সাঁটলিপি ও টাইপ শেখেন এবং পরবর্তী সময়ে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের স্ট্যানোগ্রাফার হিসেবে নিযুক্ত হন। যতীন ছিলেন শক্ত-সমর্থ ও নির্ভীক চিত্তধারী এক যুবক। অচিরেই তিনি একজন আন্তরিক, সৎ, অনুগত এবং পরিশ্রমী কর্মচারী হিসেবে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেন। একই সঙ্গে তাঁর মধ্যে দৃঢ আত্মমর্যাদা ও জাতীয়তাবোধ জন্মেছিল।
 
বাঘা যতীনের জন্ম হয় কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম শরৎশশী। ঝিনাইদহ জেলায় পৈত্রিক বাড়িতে তাঁর ছেলেবেলা কাটে। ৫ বছর বয়সে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। মা এবং বড় বোন বিনোদবালার সাথে তিনি মাতামহের বাড়ি কয়াগ্রামে চলে যান। যতীন শৈশব থেকেই শারীরিক শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। শুধুমাত্র একটি ছোরা নিয়ে তিনি একাই একটি বাঘকে হত্যা করতে সক্ষম হন বলে তাঁর নাম রটে যায় বাঘা যতীন।
 
যতীনের মা শরৎশশী দেবী ছিলেন স্বভাবকবি। সমসাময়িক বাঙালি চিন্তাবিদদের রচনাবলীর পাঠিকারূপে তিনি অবগত ছিলেন দেশের মংগলের পথ এবং সেইমতো তিনি লালন করতেন তার সন্তান দু’টিকে। পরোপকার, সত্যনিষ্ঠা, নির্ভীক চিন্তায় ও কর্মে অভ্যস্ত যতীন পড়াশোনা ও খেলাধূলার পাশাপাশি কৌতুকপ্রিয়তার জন্যও সমাদৃত ছিলেন। পৌরাণিক নাটক মঞ্চস্থ ও অভিনয় করতে তিনি ভালোবাসতেন এবং বেছে নিতেন হনুমান, রাজা হরিশচন্দ্র, ধ্রুব, প্রহ্লাদ প্রভৃতি চরিত্র।
 
যতীনের বড় মামা বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় (বিপ্লবী হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের পিতা) ছিলেন কৃষ্ণনগরের আইনজীবী এবং আইনের অধ্যাপক। তার পরামর্শ নিতেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – পার্শ্ববর্তী শিলাইদহে তার জমিদারী সংক্রান্ত নানা প্রয়োজনে। কৈশোর থেকে রবীন্দ্রনাথ যে অনুরাগ নিয়ে আন্দোলন চালিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয়দের প্রতি অবজ্ঞা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে, তারই প্রেরণায় শরৎশশী উদ্বুদ্ধ করেছিলেন যতীনকে। রবীন্দ্রনাথের ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ইতিহাস-ভক্ত। যতীনের চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে তিনি হাজির হতেন যতীনের ফুটবল ক্লাবে; সেখানে দামাল ছেলেগুলির সামনে সুরেন তুলে ধরতেন দেশপ্রেমের আদর্শ। গীতাপাঠের মধ্যে তাদের বুঝিয়ে দিতেন নিষ্কাম কর্মের উপযোগিতা। যতীন কৃষ্ণনগর শহরে এংলো ভার্নাকুলার (এ ভি) বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
 
১৮৯৫ সালে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজে (বর্তমানের ক্ষুদিরাম বোস সেন্ট্রাল কলেজ) ভর্তি হন। কলেজের পাশেই স্বামী বিবেকানন্দ বাস করতেন। বিবেকানন্দের সংস্পর্শে এসে যতীন দেশের স্বাধীনতার জন্য আধ্যাত্মিক বিকাশের কথা ভাবতে শুরু করেন। এসময়ে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিবেকানন্দের আহবানে যতীন তাঁর বন্ধুদের দল নিয়ে এই রোগে আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত হন।
 
বিবেকানন্দের পরামর্শে যতীন শরীরচর্চার জন্য অম্বু গুহের কুস্তির আখড়ায় যোগ দেন। সেখানে তাঁর সাথে সেসময়ের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের দেখা হয়। এদের একজন শচীন বন্দোপাধ্যায়ের সাথে পরিচয়ের সূত্রে তিনি শচীনের পিতা যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের সাক্ষাৎ পান। যোগেন্দ্রনাথ তখনকার ইউরোপের মাৎসিনি, গারিবল্ডি প্রমুখ ইতালীয় বিপ্লবীদের জীবনের আলেখ্য রচনা করেছিলেন।
 
কলেজ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে যতীন অ্যাটকিনসন সাহেবের স্টেনো টাইপিংয়ের ক্লাসে ভর্তি হন। সদ্য প্রচলিত টাইপরাইটার ব্যবহার করার এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মোটা মাইনের চাকুরি পাওয়া সম্ভব ছিলো। ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তিতে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠে ইস্তফা দিয়ে যতীন ১৮৯৯ সালে মজঃফরপুর চলে যান। সেখানে তিনি ব্যারিস্টার কেনেডীর সেক্রেটারি হিসাবে কাজে যোগ দেন। ভারতের জন্য মজুদ অর্থ দিয়ে ইংরেজ সরকার সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করছে সাম্রাজ্য রক্ষার স্বার্থে, তার বিরুদ্ধে কেনেডি কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে বক্তৃতা মারফৎ এবং তাঁর সম্পাদিত ত্রিহুত কুরিয়ার পত্রিকায় প্রচারণা চালাতেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তিভোগী এই ভারত প্রেমিক ব্যারিস্টার কেনেডি ছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের উপরে মৌলিক গবেষণার জন্য বিখ্যাত। দুর্ভাগ্যক্রমে কেনেডি’র স্ত্রী ও কন্যার জীবননাশ ঘটে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর বোমায়। কেনেডির উৎসাহে মজঃফরপুরের তরুণদের জন্য যতীন ফুটবল ও অ্যাথলেটিক ক্লাব গড়ে তুলেন।
 
জননী শরৎশশীর অসুস্থতার সংবাদে যতীন কয়া গ্রামে এসে দেখেন এক কলেরা রোগীর সেবা করতে করতে তার সংক্রমণে যতীনের মা মৃত্যুবরণ করেছেন। দিদি বিনোদবালার কাছে যতীন জানতে পারেন, তাঁর প্রয়াত মা কুমারখালীর উমাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে ইন্দুবালার সাথে যতীনের বিয়ের সম্বন্ধ করেছিলেন। ১৯০০ সালে যতীন ইন্দুবালাকে বিয়ে করেন। তাঁদের ৪টি সন্তান হয় – অতীন্দ্র (১৯০৩-০৬), আশালতা (১৯০৭-৭৬), তেজেন্দ্র (১৯০৯-৮৯) এবং বীরেন্দ্র (১৯১৩-৯১)।
 
যতীন মজঃফরপুরে আর ফিরবেন না – এই খবর পেয়ে কেনেডি একটি সুপারিশ দেন তাঁর বন্ধু হেনরি হুইলারের নামে, যিনি তখন বাংলা সরকারের অর্থসচিব। যতীনকে হুইলার নিজের স্ট্যানোগ্রাফার হিসাবে নিয়োগ করেন। যতীনের পেশাগত নৈপুণ্যের সংগে তাঁর আত্মসম্মানবোধ ও দেশপ্রেম মুগ্ধ করে হুইলারকে। ভারতীয় প্রজাদের উপরে ইংরেজ অফিসারদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তখন বিপিন চন্দ্র পাল New India পত্রিকায় প্রতিবাদ ছাপছেন; তারই প্রতিধ্বনি তুলে বংগদর্শনের পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন মুষ্টিযোগের উপযোগিতা বিষয়ে – ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্ত ইংরেজের পক্ষ নিয়ে সরকার যেভাবে তার বদলা নেয়, সেবিষয়ে হুঁশিয়ার করে রবীন্দ্রনাথ ইঙ্গিত দিচ্ছেন ভারতীয়দের সংঘবদ্ধ হতে। এর পিছনে প্রচ্ছন্ন আছে বিপ্লবীদের গুপ্ত সমিতি গঠনের পরিকল্পনা।
 
১৯০৩ সালে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের বাড়িতে শ্রী অরবিন্দের সাথে পরিচিত হয়ে যতীন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। সরকারী নথিপত্রে যতীন পরিচিত হন শ্রী অরবিন্দের দক্ষিণহস্ত হিসাবে। অরবিন্দ ঘোষের সংস্পর্শে এসে যতীন শরীর গঠন আখড়ায় গাছে চড়া, সাঁতার কাটা ও বন্দুক ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। যুগান্তর দলে কাজ করার সময় নরেনের (এম.এন রায়) সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং অচিরেই একে-অপরের আস্থাভাজন হন।
 
কলকাতা থেকে খবর এল, একের পর এক বিপ্লবীদের কেন্দ্রগুলিতে তল্লাস চালাচ্ছে পুলিশ। বালেশ্বরের সন্ধান পেতে দেরী নেই। দুর্গম ডুভিগর পর্বতশ্রেণী দিয়ে গা ঢাকা দেবার উপযোগিতা নিয়ে কেউ কেউ যখন জল্পনা-কল্পনা করছেন, যতীন দৃঢ়স্বরে জানালেন, “আর পালানো নয়। যুদ্ধ করে আমরা মরব। তাতেই দেশ জাগবে।” ৭ সেপ্টেম্বর গভীর রাত্রে যতীন নিজের সাময়িক আস্তানা মহলডিহাতে ফিরে এলেন। সঙ্গে চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, জ্যোতিষচন্দ্র পাল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। ৮ সেপ্টেম্বর সারাদিন কেটে গেল গভীর জংগলে। সারারাত পায়ে হেঁটে ৯ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা পৌঁছলেন বালেশ্বরের নদী বুড়ি বালামের উপকণ্ঠে। সাঁতার কেটে নদীর ওপারে গিয়ে যুদ্ধের পক্ষে মোটামুটি উপযুক্ত শুকনো এক ডোবার মধ্যে আশ্রয় নিলেন। বিপরীতপক্ষে চার্লস টেগার্ট, কমান্ডার রাদারফোর্ড, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিলভি অসংখ্য সশস্ত্র পুলিস ও সামরিক বাহিনী নিয়ে হাজির হয়েছিল। পরীখার আড়ালে বাঘা যতীনের নেতৃত্বে মোট পাঁচজন, হাতে মাউজার পিস্তল। যুদ্ধ শুরু হলে পুলিসের গুলিতে ঘটনাস্থলে শহীদ হলেন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী। এই যুদ্ধের এমন নজির ইতঃপূর্বে দেখেননি বলে মেনে নিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ কুশীলবেরা। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ সালে সূর্যাস্তের সংগে অবসান হল এই যুদ্ধের। পরদিন বালেশ্বর সরকারি হাসপাতালে যতীন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তখনো রক্তবমি হচ্ছে। হেসে বললেন:

“এত রক্ত ছিল শরীরে? ভাগ্যক্রমে, প্রতিটি বিন্দু অর্পণ করে গেলাম দেশমাতার চরণে।”

 
যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কয়েকটি পত্রঃ
[১৯১০ সালের ৪ঠা এপ্রিল তারিখে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে দিদি বিনোদবালা দেবীকে লেখা]
 
শ্রীশ্রীচরণকমলেষু-
দিদি, আমার অসংখ্য প্রণাম জানিবেন। আপনার স্নেহাশীর্বাদী পত্র পাইয়া সমস্ত অবগত হইলাম। আপনারা সকলে ভাল আছে জানিয়া সুখী হইলাম। আপনি আমার অসুখের সংবাদে ব্যস্ত হইয়াছেন, ব্যস্ত হইবেন না। আমি এক্ষণে সুস্থ হইয়াছি, তবে অসুখটা একটু বেশী হইয়াছিল তাই দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিলাম, আবার শ্রীগুরুর কৃপায় আস্তে আস্তে সবল হইতেছি। যাহা হউক, ভগবানে আত্মসমর্পণ করিয়া তাঁহারই চরণে আমাকে নিবেদন করিয়া রাখুন, তিনি যেমন আমাকে শৈশব হইতে নানা বিপদে রক্ষা করিয়া আসিতেছেন, এস্থলেও তিনিই একমাত্র ভরসা। তিনি যাহাকে যত বেশি ভালবাসেন তাহাকে তত বেশি পরীক্ষা করেন এবং সেইজন্যই নানা বিপদের মুখে নিপাতিত করিয়া তাঁহারই অস্তিত্ব বুঝাইয়া দেন।- তিনি যাহা করিবেন তাহার উপর মানুষের বিন্দুমাত্র হাত নাই; মানুষ কেবল তাঁহাতে নির্ভর করিয়া পুরুষকার করিতে পারে; ফলাফল তাঁহারই হাতে। যাহা হউক আমার জন্য কোন চিন্তা করিবেন না। তাঁহার প্রতি চাহিয়া বুক বাঁধিয়া সংসারে অবস্থান করুন। আমাপেক্ষাও ভগবানের অধিক স্নেহ আপনার প্রতি, তাই আপনার পরীক্ষা আমাপেক্ষা অধিক ও কঠিনতর। যাহা হউক, তাঁহার দয়া ভুলিবেন না। অথবা তাঁহাকে অবিশ্বাস করিবেন না। ইন্দুকে ও অপর সকলকে এই পত্রই দেখাইবেন। মেজমামাকে আর একবার সাক্ষাৎ করিতে বলিবেন।-তাঁহারা সকলে কেমন আছেন?
 
 
শ্রীচরণে নিবেদনমিতি
প্রণত সেবক
জ্যোতি
 
 
২০ অগাস্ট, ১৯১০-এর পত্র :
[১৯১০ সালের ২০শে অগাস্ট জেল থেকে দিদিকে এই পত্রটি লেখা]
 
 
শ্রীশ্রীচরণকমলেষু-
দিদি, আমার অসংখ্য প্রণাম জানিবেন। আপনার স্নেহাশীর্বাদী পত্র পাইয়া সমস্ত অবগত হইলাম এবং সকলেই শারীরিক কুশলে আছেন জানিয়া সুখী হইলাম।-খোকাদের লইয়া সর্বদা সাবধানে থাকিবেন। আমি আর সে বিষয়ে আপনাকে কি লিখিব?-আমার জন্য বিশেষ কোন চিন্তা করিবেন না-আমি শারীরিক ভাল আছি। মেজমামাকে মধ্যে মধ্যে পত্র লিখিব: তিনিই আপনদিগকে আমার সংবাদ লিখিবেন। কতদিনে মোকদ্দমা উঠিবে এখনও জানিতে পারি নাই।-যাহা হউক সেই সর্বমংগলময় পরম পিতার চরণের দিকে চাহিয়া আছি।-তিনি যে বিধান করেন, তাহাই তাঁহার আশীষ বলিয়া গ্রহণ করিব। তিনি আমাদের অমংগলের জন্য কখনই কিছু করেন না। আপাত দৃষ্টিতে যাহাকে অমংগল বলিয়া বোধ হয়, তাহারো পশ্চাতে কোন মহদুদ্দেশ্য নিহিত থাকে, যাহা ভ্রান্ত আমরা বুঝিতে পারি না। তাঁহার উপরে সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করিয়া প্রাণে বল ধরিয়া সময় প্রতীক্ষা করুন-অবশ্য নির্দোষীকে তিনি বিপন্মুক্ত করিবেন। যথাযোগ্য স্থানে আমার প্রণাম ও আশীষ দিবেন।
ইতি-
প্রণত সেবক জ্যোতি
 
 
১৯১৫ সালের মে মাসের পত্র :
[১৯১৫ সালের মে মাসে বালেশ্বরের অজ্ঞাতবাস থেকে এই চিঠিটি দিদি বিনোদবালাকে লেখা]
 
শ্রীশ্রীচরণকমলেষু-
দিদি আমার অসংখ্য প্রণাম জানিবেন। আমি বেশ ভাল স্থানে সর্বাংগীণ কুশলে আছি। আমার জন্য কোন চিন্তা করিবেন না। কর্মের নিমিত্ত বাহির হইয়াছি, ভবিষ্যতে সাক্ষাতাদি কর্মের উপরই নির্ভর করিতেছে। শীঘ্রও হইতে পারে, কিছু বিলম্বও হইতে পারে। তবে নিরাশ হইবার বা ভয়ের কোন কারণ দেখি না। সর্বদা স্মরণ রাখিবেন “ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিৎ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি”। মার আশীর্বাদে সমস্ত বিপদ হইতে উদ্ধার হইয়াছি-তিনি সমস্ত কর্মে সর্বদা যেমন সাহায্য করিয়াছেন, এ বর্তমান অবস্থায়ও তেমনি সাহায্য করিবেন সন্দেহ নাই-তাঁহারই প্রেরণায় এ কর্ম-সমুদ্রে ঝাঁপাইয়াছি, তিনি কূলে লইবেন। আপনি যে মার সন্তান তাঁহার হৃদয়ের কথা স্মরণ করিয়া আপন হৃদয়ে বল রাখিয়া যে সকল রত্নগুলি আপনার নিকট আছে তাহাদের যাহাতে উদ্দেশ্যানুযায়ী কর্মের উপযোগী করিয়া ভবিষ্যতে মায়ের পূজায় অর্পণ করিতে পারেন, সেই চেষ্টা করিবেন। আপনি ব্যস্ত হইলে ইন্দুদের নিকট কি আশা করেন? আপনি ব্যস্ত হইবেন না। সমস্তই বুঝেন। সংসারে সমস্তই যে কত অস্থায়ী তাহা আপনি অনেক প্রকারে দেখিয়াছেন এবং বুঝিয়াছেন। এই অস্থায়ী সংসারে অস্থায়ী জীবন যে ধর্মার্থে বিসর্জন করিতে অবকাশ পায় সে তো ভাগ্যবান এবং তাহার সমস্ত শুভাকাংক্ষী আত্মীয়-স্বজন, বিশেষত তাহার মাতৃস্থানীয়া সহোদরা যদি স্থিরভাবে চিন্তা করিয়া দেখেন তাহা হইলে নিজেদের বংশের সৌভাগ্যের কথা বেশ উপলদ্ধি করিতে পারেন এবং ধর্মার্থে বহির্গত ব্যক্তির সাধনায় সিদ্ধির পূর্বে তাহার গৃহে প্রত্যাবর্তন কখনই বাঞ্ছনীয় মনে করেন না, বরং তাহার মন্ত্রের সাধন পথের সহায়তার নিমিত্ত তাহার অবর্তমানে গৃহে বুক বাঁধিয়া ভগবানে নির্ভরতা সহকারে পরস্পরের রক্ষণাবেক্ষণ ও শান্তিদান করাই তাহাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় এবং এই শ্রেণীর ব্যক্তিরাই জগতে ধন্য এবং সার্থক মাতৃস্তন্য পান করিয়াছেন। হা-হুতাশ তো সকলেই করিয়া থাকে, আপনি আমিও যদি তাহাই করি তবে আমরা আমাদের স্বর্গীয়া মাতৃদেবী শরৎশশীর গর্ভে জন্মিয়াছিলাম কেন? আমরা ত সাধারণের ন্যায় দুর্বল হৃদয় অবিশ্বাসী সামান্য মায়ের সন্তান নই-আমাদের মা জীবন ভরিয়া কি সকল ব্যাপার হাসিতে হাসিতে সহ্য করিয়া গিয়াছেন একবার ভাবিয়া দেখুন তা আর আজ তিনি জীবিত থাকিলে তিনি স্বয়ং আমাকে আমার কর্মে বরণ করিয়া লইতেন সন্দেহ নাই। তাঁহার অবর্তমানে যাহার হাতে আমাকে তিনি রাখিয়া গিয়াছিলেন, আমার সেই মাতৃস্বরূপিণী সহোদরা ও গুরুভগ্নীর কি করা কর্তব্য একটু ভাবিয়া দেখিবেন। আপনি ইতিপূর্বে একসময়ে কোন বিপদের সময় আমাকে লিখিয়াছেন, “আমাদের অপেক্ষা যিনি তোমাকে বেশি ভালবাসেন তিনিই সর্বদা তোমার কথা ভাবিতেছেন, আমরা তোমার নিমিত্ত চিন্তা করিয়া কি করিব।” আপনার অবস্থা এতদিনে আরও উন্নত হওয়ার কথা। হৃদয়ের বল এখন আরও অধিক হইয়াছে আশা করা যায়। আপনি অনুগ্রহ করিয়া মন শান্ত করিয়া সসন্তান ইন্দুকে রক্ষা করিবেন। সন্তানগুলি যাহাতে মানুষ হয় তাহার চেষ্টার যেন কোন ত্রুটি না হয়। কখন কোন বিষয়ের প্রয়োজন হইলে ভাইদের কাহাকেও স্মরণ করিবেন এবং আমার মত জ্ঞান করিয়া প্রয়োজন জানাইবেন, অভাব থাকিবে না। কোথায় আছি জানিয়া প্রয়োজন নাই-পত্র পাইলেন তাহাও কাহাকে বলিবার প্রয়োজন নাই। প্রেরিত লোকের নিকট বক্তব্য যদি কিছু থাকে জানাইবেন। সমস্ত গুরুজনদিগকে প্রণাম ও আশীর্বাদভাজনগণকে স্নেহাশীষ দিবেন। স্মরণ রাখিবেন বিপদের সময় স্থৈর্য্য সহকারে বুদ্ধির আশ্রয় গ্রহণ করাই বিধেয়। পরমারাধ্য শ্রীগুরুদেবের চরণে সদা মতি রাখিবেন। তাঁহাকে পত্রাদি লিখিবেন।
 
শ্রীচরণে নিবেদন ইতি
প্রণত সেবক-
 
(অস্পষ্ট)
১৯১৫ সালের মে মাসে অজ্ঞাতবাস থেকে লেখা :
 
[১৯১৫ সালের মে মাসে বালেশ্বরের অজ্ঞাতবাস থেকে যতীন্দ্রনাথ এই পত্রটি লেখেন ইন্দুবালা দেবীকে; স্ত্রীকে লেখা এটি তার একমাত্র পত্র যা রক্ষা করা গিয়েছে পুলিশের আক্রমণ থেকে। বছরে একবার অন্তত পুলিশে এসে খানাতল্লাস ক’রে যেত তার দিদি ও স্ত্রীর কাছে যদি দৈবাৎ আপত্তিজনক কিছু পাওয়া যায়-এই প্রত্যাশা নিয়ে। তাদেঁর মৃত্যুর আগে জ্যেষ্ঠা পুত্রবধু ঊষারাণী দেবীর হাতে তারা এই অমূল্য পত্রগুলি গচ্ছিত রেখে যান।]
 
পরমকল্যাণবরাসু-
ইন্দু, আমার স্নেহাশীষ লও। তোমাকে আর পৃথক কি লিখিব, দিদিকে যে পত্র আমি লিখিলাম উহা পড় ও মর্ম অবগত হও। ভগবদিচ্ছায় আজ ১৫/১৬ বৎসর আমার সহিত মিলিত হইয়াছ। এই দীর্ঘকাল যখন সময় পাইয়াছি তখনই বহুপ্রকারে বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছি প্রকৃত মনুষ্যত্ব কোথায়। অদ্য যে অবস্থা আসিয়াছে এ অবস্থা যে এক সময় আসিবেই এ সম্বন্ধে নানাপ্রকার তোমাকে বুঝাইয়াছি এবং প্রস্তুত থাকিতেও বলিয়াছি। আশা করি তোমার মত ক্ষেত্রে আমার সকল শিক্ষার বীজ আশানুরূপ ফল প্রসব করিয়াছে। বহু বহু সহস্ত্রের মধ্যে একজনের নিকট যেরূপ শক্তি, ধৈর্য ও কর্তব্যজ্ঞানের বিশেষ বিকাশ দেখিতে পাওয়া যায় তোমার নিকট প্রকৃতই তাহাই আশা করি। সন্তানগুলি যাহাতে ভবিষ্যতে মানুষের সন্তান বলিয়া পরিচিত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখিতে ভুলিও না। ক্ষণিক দুর্বলতা সকলেরই আসিতে পারে; সেরূপ অবস্থায় দিদিকে সাহায্য করিও ও তাঁহার সাহায্য গ্রহণ করিও। সর্বদা মনে রাখিও যে প্রকৃতি লইয়াই পুরুষ পূর্ণ-যত দূরেই থাকি না কেন, তোমার প্রসন্নতা ও শুভেচ্ছাস্বরূপ শক্তির সাহায্য যেন সদা পাই। সর্বদা শ্রীগুরুদেব ও ভগবৎ চরণে তোমার স্বামীর সিদ্ধির নিমিত্ত প্রার্থনা করিও এবং হৃদয়ে বল রাখিও।
ইতি-
 
বাঘা যতীন ও তার সাথীদের অসমসাহসী যুদ্ধের কথা বাংলা কবিতায় প্রতিভাত হয়েছে দুই বিখ্যাত কবি দ্বারা। কাজী নজরুল ইসলামের প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থের ‘নব ভারতের হলদিঘাট’ তাদের লড়াইকে স্মরণ করে রচিত। ১৯৩০ এর ডিসেম্বরে প্রলয় শিখা বইয়ের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ আনে সরকার। চারণ কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের ‘বুড়িবালামের তীরে’ তার বই ‘সব হারানোর গান’ এ স্থান পেয়েছে।
বাঘা যতীনের জীবনকাহিনী নিয়ে বাংলা সিনেমা ‘বাঘা যতীন’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। অভিনয় করেন ধীরাজ ভট্টাচার্য, নিমু ভৌমিক, ছায়া দেবী প্রমুখ।
 
 

 

কলমে – শেখ আনিসুর রহমান আনিস
ঢাকা, বাংলাদেশ।
 
 
 
 
।। আগ্রহী লেখকদের আহ্বান।।

আপনাদের মূল্যবান লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের। যেকোনোও সময়, যেকোনও দিন। আমরা প্রকাশ করবো।

বিষয়:-
বিজ্ঞানের আবিষ্কার,চলচ্চিত্র, খেলাধুলা, সভা-সমিতি, মনীষীদের জীবন, ধর্মান্ধতা, সামাজিক সংকট, কুসংস্কার বিরোধী, পলিটিক্যাল স্ক্যাম, পলিটিক্যাল ইস্যু, পলিটিক্যাল টেরোরিজম, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এমন যেকোন বিষয়েই লেখা পাঠানো যাবে।
 
নির্দিষ্ট কোন শব্দ সীমা নেই।
WhatsApp করে লেখা পাঠান:- 8116447650
…. প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন আমাদের WhatsApp নম্বরে

Leave a Reply