প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক উপাদান ও তার প্রভাব
ভূগোলের জ্ঞান ব্যতিরেখে ইতিহাস অধ্যায়ন সম্পূর্ণ হয় না। তাই ভারতবর্ষের ইতিহাস বোঝার জন্য দেশের ভৌগোলিক বিবরণ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার। বিশালতা ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভারতবর্ষ এক অসাধারণ দেশ। ইউরোপ থেকে রাশিয়াকে কে বাদ দিলে যে আয়তনে হয়, প্রাচীন ভারতবর্ষ তার চেয়েও আয়তনে বড়। ভারতের ভূপ্রকৃতিও মহাদেশের মত বৈচিত্র্যময়। মাউন্ট এভারেস্টের মত গিরিশৃঙ্গ, চেরাপুঞ্জির মত বারিপাত যুক্ত অঞ্চল, রাজস্থানের মত দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমি, দণ্ডকারণ্যের মত গহন অরণ্য এবং সিন্ধু-গঙ্গা- বিধৌত অঞ্চলের মত উর্বর সমভূমি – সবই ভারতে বিদ্যমান। মহাদেশ সুলভ এই বিশালতা, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করে পণ্ডিতরা ভারতবর্ষকে “ক্ষুদ্রাকৃতি মহাদেশ” বা “উপমহাদেশ” আখ্যা দিয়েছেন।
প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা বিচার করে পণ্ডিতরা ভারতকে মোট পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করেছেন-
১) উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল :- হিমালয় সংলগ্ন কাশ্মীর, কাংড়া, নেপাল, সিকিম, ভুটান প্রভৃতি রাজ্য এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।
২) সিন্ধু-গঙ্গা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র- বিধৌত সমতল অঞ্চল:– হিমালয় থেকে উৎপন্ন সিন্ধু, গঙ্গা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র- বিধৌত এবং প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ এই অঞ্চল প্রাচীন ভারতের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত।
৩) মধ্য-ভারতের মালভূমি:– সিন্ধু-গঙ্গা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের সমতল ভূমির দক্ষিনে এবং বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতের উত্তরে এই অঞ্চল অবস্থিত।
৪) দাক্ষিণাত্যের মালভূমি :- বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতের দক্ষিনে অবস্থিত এই সুবিশাল অঞ্চলের পূর্বদিকে পূর্বঘাট পর্বতমালা ও পশ্চিমে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা দণ্ডায়মান।
৫) সুদূর দাক্ষিণাত্য:- কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণ থেকে কুমারিকা অন্তরীপ পর্যন্ত বিস্তৃত প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি এই অঞ্চলটি ‘ সুদূর দাক্ষিণাত্য ‘ নামে পরিচিত।
ফরাসি দার্শনিক বোদ্রাঁ বলেছেন, ” ভূগোল ও আবহাওয়া বিভিন্ন জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করে।” সত্যি কথা বলতে কি প্রত্যেক দেশের ইতিহাসের বিবর্তনে সেই দেশের ভৌগলিক প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ভারতের নানান ভৌগলিক উপাদান ভারতবাসীর চরিত্র, জীবন-দর্শন ও চিন্তাধারার ক্ষেত্রে সবিশেষ প্রভাব ফেলেছে তা লক্ষ্যণীয়।
হিমালয়ের প্রভাব:-
ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসে হিমালয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। দুর্ভেদ্য হিমালয় পর্বতমালা ভারতের উত্তরে সজাগ প্রহরীর মতো দণ্ডায়মান থেকে ভারতকে বহিঃশত্রুর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেছে এবং উত্তর ও মধ্য এশিয়ার প্রচন্ড শীতল বায়ু বায়ুপ্রবাহকে প্রতিহত করে উত্তর ভারতের জলবায়ুকে নাতিশীতোষ্ণ রেখেছে। হিমালয়ের গিরিপথ গুলির মধ্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে বিদেশীরা যেমন ভারতে এসেছে, তেমনি ভারতবাসীরাও পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সংস্কৃতি সম্পর্ক স্থাপন করেছে। হিমালয় থেকে নির্গত নদ-নদী গুলির একদিকে যেমন উত্তর ভারতের সমভূমিকে সুজলা সুফলা করেছে, তেমনি দক্ষিণ-পশ্চিমের মৌসুমি বায়ুকে প্রতিহত করে বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে হিমালয় কৃষি কাজে সহায়তা করে। তাই মিশরকে যদি ‘ নীলনদের দান’ বলা হয়, তাহলে একইভাবে ভারতবর্ষকেও ‘হিমালয়ের দান’ বলা যেতে পারে। ভারতবাসীর ধর্ম-জীবনেও হিমালয়ের দান প্রচুর। হিমালয় হল ভারতীয় ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতীক।
বিন্ধ্য পর্বতের প্রভাব:-
হিমালয় ছাড়া অন্য যে পর্বতটি ভারতের ইতিহাসকে যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে, তা হচ্ছে বিন্ধ্য পর্বত। ভারতের মাঝখানে অবস্থিত বিন্ধ্য পর্বতমালা ভারতকে আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্য – এই দু’ভাগে বিভক্ত করেছে। প্রাচীনকালে এই দুই অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে গড়ে না ওঠায় দাক্ষিণাত্যে দ্রাবিড় সংস্কৃতি বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
এমনকি, বিন্ধ্যপর্বতের জন্যই দক্ষিণ ভারতকে উত্তর ভারতের মতো বার বার বিদেশে আক্রমণে বিধ্বস্ত হতে হয়নি। এর ফলে দক্ষিণ ভারতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বহুলাংশে বজায় থেকেছে এবং এই অঞ্চলে ব্যবসা বাণিজ্য তার নিজস্ব গতিতে বাধাহীনভাবে প্রসার লাভ করার সুযোগ পেয়েছে।
কিন্তু, এই পর্বত বেশিদিন ধরে দ্রাবিড়দের আর্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারেনি। কালক্রমে মৌর্য, গুপ্ত, খলজি ও মোঘলরা এই পর্বতমালা অতিক্রম করে ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় রাষ্ট্রের সূত্রপাত করে। এইভাবে ধীরে ধীরে আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যের মধ্যে আর্থসামাজিক তথা রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠে এবং সেই সঙ্গে আর্য ও অনার্য দুই সভ্যতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ভারতীয় সভ্যতার মূলধারা।
নদ-নদীর প্রভাব:-
ভারতের ইতিহাসের ধারা পরিচালনায় নদ-নদীর প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদী – রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ” নদী জপমালা, ধৃত প্রান্তর”। প্রাচীন যুগে সিন্ধু সভ্যতা ও পরবর্তী দিনে আর্য সভ্যতার বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছিল নদীর উপত্যকায়। – এমনকি কাশী, মথুরা, প্রয়াগ, দিল্লি, আগ্রা প্রভৃতি শহরগুলির নদীর পাশে গড়ে উঠেছিল।
সিন্ধু ও গঙ্গা-উপত্যকার উর্বর শস্য-শ্যামলা অঞ্চল যুগে যুগে বিদেশি জাতিগুলিকে ভারতে আসতে প্রলুব্ধ করেছে। শুধু তাই নয়, এই সমস্ত নদ-নদীর তীরেই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র অবস্থিত ছিল।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাস্তাঘাট না থাকায় নদীপথে নৌকা করে মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করত। যে অর্থে বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও আঞ্চলিক রাজনীতি ও সংস্কৃতি বিকাশে সাহায্য করেছে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন নদনদী। তাই বলা যায় যে, ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তনে ভারতের বিভিন্ন নদ-নদীর বিপুল প্রভাব রয়েছে।
সমভূমির প্রভাব:-
ভারতবর্ষের অতি উর্বর সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অধ্যুষিত এবং পরিপুষ্ট সমভূমি অঞ্চলকে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার জন্ম ভূমি বলা যায়। সামান্য পরিশ্রমেই এই অতি উর্বর সমতল ভূমিতে প্রচুর ফসল ফলে। খাদ্যের চিন্তামুক্ত এই নিশ্চিন্ত জীবনই ভারতবাসীদের কলা ও শিল্পে পারদর্শী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দার্শনিক চিন্তা, ধর্মাচরণ, সাহিত্য রচনা ও মননশীল চিন্তাধারার সুযোগ করে দেয়, যা যুগে যুগে মৌর্য, গুপ্ত, কুশান, পল্লব, সাতবাহন, সুলতানি ও মুঘল সভ্যতার মধ্যে দিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।
সমুদ্রের প্রভাব:-
সমুদ্রের অবস্থানও যুগে যুগে ভারতের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। ভারতবর্ষের তিনদিক সমুদ্রবেষ্টিত থাকায় একদিকে যেমন জলপথে বহিঃশত্রুর আক্রমণের সম্ভাবনা কমেছে, অন্যদিকে সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতবাসীদের পক্ষে সমুদ্রপথে বাণিজ্য ও উপনিবেশ স্থাপন করা সহজ হয়ে উঠেছে। এর ফলস্বরূপ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, যেমন সুমাত্রা, বর্ণিও, জাভা, সিংহল প্রভৃতি ভারতীয় উপনিবেশ স্থাপতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এইসব অঞ্চলে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে।
পরবর্তীকালে ইউরোপীয় জাতিগুলি সমুদ্রপথে ভারতে প্রবেশ করে উপনিবেশ গড়ে তোলে। এরই অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ ভারতের শাসনভারও যায় তাঁদের হাতে, অর্থাৎ ভারতের রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে।
পরিশেষে বলা যায় যে, বিশাল ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈচিত্র্যপূর্ণ ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ভারতীয়দের চরিত্র, জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবিকা ও বৃত্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পার্থক্যের সৃষ্টি করেছে।