[New] ফরাজি আন্দোলনের কারণ ও তাৎপর্য [Faraizi Movement]। Nana Ronger Itihas। PDF [Download]

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now
 

ফরাজি আন্দোলনের  কারণ  ও তাৎপর্য
ফরাজি আন্দোলনের কারণ
ফরাজি আন্দোলনের প্রভাব
ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব / তাৎপর্য
দুদুমিঞা
ফরাজি আন্দোলনের ব্যর্থতা
ফরাজি আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা

ফরাজি আন্দোলন:-

বিদেশি ইংরেজের শাসন-শোষণ এবং ইংরেজ সমর্থিত জমিদার শ্রেণীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে উনবিংশ শতকে সাধারণ মানুষের বিদ্রোহ বারে বারে দেখা যায়। অনেক সময় সাধারণ কৃষক বিদ্রোহ হিসেবে এই অসন্তোষ আত্মপ্রকাশ করে। কখনও ধর্মের আবরণে সাধারণ মানুষ সঙ্গবদ্ধ হয়ে নৈতিক শক্তি লাভ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। শোষকশ্রেণী ধর্মকে শোষণের হাতিয়ার, ভেদনীতির যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলেও, শোষিতশ্রেনী ধর্মের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনে সমর্থ হয়েছে, এমন ঘটনাও দেখা যায়। ফরাজি আন্দোলনের ক্ষেত্রে ধর্মের এই প্রগতিশীল, জাগৃতির ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়।
আরবি থেকে উদ্ভূত ‘ফরাইজ’শব্দের অর্থ “ইসলাম-নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য।” এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বঙ্গদেশ। ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তক হাজি-শরিয়ৎ উল্লাহ।

ফরাজি আন্দোলনের কারণ: 

১) হাজি সরিয়তুল্লাহ ঘোষণা করেন, ব্রিটিশ শাসনে ভারত দার-উল-হার্বে পরিণত হয়েছে এবং প্রত্যেক ভারতবাসী মুসলিমদের উচিত ইংরেজদের ভারত থেকে বিতাড়িত করা। সরিয়তুল্লাহর  প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে বহু গরিব মুসলিম কৃষক তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং ফরাজি আন্দোলন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
২)সরিয়তুল্লাহ তাঁর সমর্থকদের জমিদার ও নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। হিন্দু জমিদার মাঝে মাঝেই পূজা-পার্বণে ও হিন্দু ধর্মের উৎসব অনুষ্ঠানের খরচ তোলার জন্য নানা আবওয়াব দাবি করতেন। ফরাজিরা এইসব আবওয়াব দিতে হয়তো অক্ষম ছিলেন না। কিন্তু তাদের প্রধান অভিযোগ হল এই যে, ইসলাম ধর্মে মূর্তিপূজার কোন স্থান নেই। সুতরাং তারা এসব কর দিতে বাধ্য নন। ফলে ফরাজিরা এইসব আবওয়াব দিতে অস্বীকার করে।
৩) ভূমিকর সম্পর্কে দুদুমিঞা ঘোষণা করেন, “জমি আল্লাহর দান। সুতরাং এর উপর কর ধার্য করার কোন অধিকার নেই”। তিনি তাঁর সমর্থকদের জমিদারের খাজনা না দেবার, নীলকরদের নীলচাষ না করার এবং বিদেশি ইংরেজদের না মানার আহ্বান জানান। নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র কৃষক তাঁর নেতৃত্বে সমবেত হয়।
ফরাজিদের প্রচারের ফলে জমিদারদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। সুতরাং ফরাজি আন্দোলন মুসলিম সম্প্রদায়ের সংস্কারবাদী ও পুনরুজ্জীবনের আন্দোলন জমিদার বিরোধী আন্দোলন পরিণত হয়।

দুদুমিঞা:

১৮৩৭ সালে শরিয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন বা দুধু মিঞা ফরাজি আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮১৯ সালে। পিতার মতো তিনিও জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, জমিদার ও নীলকরদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে হলে ব্রিটিশ প্রশাসনের উচ্ছেদ ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা নেই, কারণ সরকার তাঁদের সংগ্রামে শোষকশ্রেণীরর পক্ষে। তিনি ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে সাম্যের বাণী প্রচার করে কৃষক সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করলেন। তাঁর নেতৃত্বেই ফরাজি আন্দোলনের রাজনৈতিক দিক অধিকতর গুরুত্ব অর্জন করে এবং ফরাসজদের জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে তীব্র আকার ধারণ করেছিল। তিনিই এই আন্দোলনকে একটি সংগঠিত রূপ দেন। তিনি সমস্ত পূর্ববঙ্গকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করে সেখানকার দায়িত্ব তাঁর একজন প্রতিনিধি বা খলিফার হাতে দিতেন। সেই সঙ্গে ইংরেজদের আদালত বর্জন করে নিজেদের মধ্যে সমস্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ওপর জোর দেন। শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য সামরিক সংগঠন এবং লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন। এইভাবে সংগঠন কে শক্তিশালী ও জোরদার করে তুমি অপরাধীদের জমিদার নীলকর বিরোধী আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করে।

ফরাজি আন্দোলনের বিস্তার:

ক্রমে এই আন্দোলন ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ, কুমিল্লা, ময়মনসিং, খুলনা, যশোহর ও চব্বিশ পরগনার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ফরিদপুরের একটি নীলকুঠির ম্যানেজার ডানলপকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য ফরাজিরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে।ডানলপের সঙ্গে দুদুমিঞার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল খুবই তিক্ত। ডানলপও দুদুকে নানা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে উত্যক্ত করতে শুরু করেন ও সরকারের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠান। তাঁরই চক্রান্ত ও প্ররোচনায় দুদুকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।ডানলপের সঙ্গে তাঁর এই আপসহীন সংগ্রামের ফলে ডানলপের নীলকুঠি ধ্বংস হয়। জমিদারদের সম্পত্তির বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়। আন্দোলন ক্রমশ এত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে,  দুদুকে বারবার গ্রেপ্তার করা হলেও তিনি প্রমাণ অভাবে মুক্তি লাভ করেন। 

ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব / তাৎপর্য:

ব্যর্থতা সত্ত্বেও ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই আন্দোলনের নেতারা অবহেলিত ও অত্যাচারিত কৃষক সম্প্রদায়ের মনে জমিদার ও নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে আশার আলো জ্বালিয়ে ছিলেন। ধর্মীয় কুসংস্কার ও ইসলাম বিরোধী আচার-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন শুরু হলেও এর রাজনৈতিক কর্মসূচি ও ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পরিকল্পনা কৃষকদের উদ্দীপ্ত করেছিল এবং ঢাকার পুলিশের বড় কর্তা ডেমিপিয়ার তাঁর এক রিপোর্টে স্বীকার করতে বাধ্য হন, দুদুর আন্দোলন সরকারবিরোধী আন্দোলনে পর্যবসিত হয়ে এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
ফরাজি আন্দোলন অবহেলিত ও অত্যাচারিত কৃষক সম্প্রদায়ের মনে জমিদার ও নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে আশার আলো জ্বালিয়ে ছিল। ধর্মীয় কুসংস্কার ও ইসলাম বিরোধী ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এর বিরুদ্ধে এই আন্দোলন শুরু হলেও এর রাজনৈতিক কর্মসূচি ও ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পরিকল্পনা কৃষকদের উদ্দীপ্ত করেছিল।

ফরাজি আন্দোলনের ব্যর্থতা:

আতঙ্কিত জমিদার, মহাজন ও নীলকররা দুদুমিঞার বিরুদ্ধে লুণ্ঠন (১৮৩৮ খ্রীঃ) ও হত্যার (১৮৪১ খ্রীঃ) অভিযোগ আনে। কিন্তু গ্রামবাসীর কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় তার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কোন সাক্ষী পাওয়া যায়নি, তাই তাঁকে সরকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। যদিও সিপাহী বিদ্রোহে (১৮৫৭ খ্রীঃ) জড়িত থাকার অভিযোগ এনে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং বন্দী অবস্থায় তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। এই ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণেই কারামুক্তির পর তিনি মারা যান (১৮৬০ খ্রীঃ)।
অতঃপর ফরাজি আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে। তার ছেলে আব্দুল গফুর (নোয়া মিঞা) ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উপর জোর দিলে আন্দোলন ক্রমশঃ জনসমর্থন হারায় এবং শেষ অবধি স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ওয়াহাবী আন্দোলনের সঙ্গে মিশে যায়।

ফরাজি আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা:

১)ফরাজি আন্দোলনে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব ক্রমশ অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। তাদের অসহিষ্ণু মনোভাব ও হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব ও আচরণ তাদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে আচ্ছন্ন করে দেয়। ইসলাম ধর্মে বিচ্যুতি ও অধঃপতনের জন্য তারা হিন্দুদের দায়ী করতে থাকে। অথচ গোড়ার দিকে যখন তারা হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, তখন তাদের মধ্যে হিন্দু ধর্ম প্রসূত কোন বিদ্বেষ ছিল না। তাদের এই অসহিষ্ণু মনোভাব কিন্তু কেবলমাত্র হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রকাশিত হয়নি। এমনকি মুসলিমদের মধ্যে যারা তাদের বিরুদ্ধে করেছিল, তারাও রেহাই পায়নি। জোরজুলুম বা জবরদস্তি করে তারা তাদের মতাদর্শ অন্যান্য মুসলিম গোষ্ঠীর উপর চাপাতে চেয়েছিল এবং ফলে কিছু কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছিল।
২) ফরাজিদের ব্রিটিশ বিরোধীতাও ক্রমশ স্তিমিত হয়ে এসেছিল। দুদুমিঞা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে ছিল যে, তাঁর সংগ্রাম জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে। স্থানীয় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে গেলেও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগ ছিল না। এমনকি স্থানীয় শাসনে দুদু কিছু দায়িত্ব গ্রহণ করতেও প্রস্তুত ছিলেন। তাঁর এই মনোভাব ব্রিটিশ বিরোধিতা নয়, বরং ব্রিটিশ আনুগত্যের পরিচায়ক। সুতরাং ফরাজি আন্দোলন কে পুরোপুরি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না।

উপসংহার:

ভারতের ব্রিটিশ শাসনের প্রথম একশত বৎসরে নানান প্রতিবাদ প্রতিরোধ ও বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়েছে কোম্পানির সরকারকে। ইংরেজ কোম্পানির শাসন এবং জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার ও শোষণ সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করে। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল ফরাজি আন্দোলন।
ফরাজি আন্দোলনের সূত্রপাত হাজী শরীয়ত উল্লাহ এর মাধ্যমে ঘটলেও এ আন্দোলন সুসংহত ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যান তাঁর পুত্র দুদু মিঞা। অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দুদু মিঞার সময়ে ফরাজি আন্দোলন সাড়া জাগায় এবং দুদুমিঞার মৃত্যুর পর নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক শিক্ষার অভাব, হিন্দু বিরোধী মনোভাব, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, বলপূর্বক সাধারণ মানুষকে দলভুক্ত করা, অর্থ আদায় করা এইসব কারণে শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

Leave a Reply