প্রাক-আধুনিক চিন সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্য | Society, Religion, Economy, and Foreign Trade – Pre-modern China
প্রশ্ন : প্রাক আধুনিক চিনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কিরূপ ছিল? তুমি কি মনে কর এই ব্যবস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল ?
Question: What was the economic system of pre-modern China? Do you think this system was self-sufficient?
উত্তর :
পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ চিনে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক জনগণের বাস হলেও এর ১/৫ অংশ ১৫০০ ফুট উচ্চতার উপরে অবস্থিত এবং ৪/৫ অংশ পার্বত্য অথবা শুষ্ক অঞ্চল, যা নিবিড় চাষের অনুপযুক্ত। তা সত্ত্বেও ভূপৃষ্ঠ ও জলবায়ুর দিক থেকে চিন মূলতঃ কৃষিভিত্তিক দেশ। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতক থেকেই চিনে জমির উপর সামন্ত স্বত্ত্ব চলে গিয়েছিল। জমির মালিকানা ছিল ব্যক্তিগত। বেশ কিছু জমির মালিক ছিল জমিদার, যিনি চাষীদের জমি ভাড়া দিতেন। কিছু জমি কৃষকের নিজস্ব মালিকানায় ছিল এবং তারা নিজে চাষ করত। কনফুসীয় বিধান অনুযায়ী সামাজিক কাঠামোয় কৃষকদের উচ্চস্থান থাকলেও বাস্তবে কৃষকের জীবন ছিল দুর্বিষহ। উৎপাদিত ফসলের প্রায় সবটাই জীবন ধারণের জন্য ব্যয়িত হত। অবশিষ্ট কিছু অংশ দৈনন্দিন জীবনের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ক্রয়ে ব্যয়িত হত। চিনা কৃষি অর্থনীতির এই বৈশিষ্ট্যকে Subsistance Economy আখ্যা দেওয়া যায়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে চিনে বেশীর ভাগ কৃষকই ছিল ভাড়াটে চাষী।
চিনে কৃষকদের এই দুর্বিষহ অবস্থা বারবার কৃষকদের বিদ্রোহে প্ররোচিত করেছিল। হান বংশ থেকে শুরু করে কুয়োমিনটাং ও সাম্যবাদী চিনা সরকারের আমলেও চিনা সরকারের মূল সমস্যা ছিল অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং কৃষকদের চূড়ান্ত দারিদ্র্য।
নানা অসুবিধা সত্ত্বেও চিনের কৃষি উৎপাদন এতটাই বেশী ছিল যে কৃষকের স্বপ্ন উদ্বৃত্ত ব্যাপক বাণিজ্যের উপযোগী ছিল। চিন সারা বিশ্বকে চাল, সোয়াবিন, মিলেট, বার্লি, মিষ্টি আলু উৎপাদনের দিক থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং তার সাথে সাথে চা, সিল্ক, তামাক, গম, এবং তুলো উৎপাদনে চিন ছিল অগ্রগণ্য। চিনে জমি চাষের কৌশল আধুনিক বিচারে অবৈজ্ঞানিক হলেও প্রতি একর উৎপাদনের ক্ষেত্রে চিন যথেষ্ট অগ্রণী ছিল। চিনের কৃষি ব্যবস্থা থেকে যে প্রধান রাজনৈতিক সমস্যা উদ্ভূত হয়েছিল তা হল প্রজাস্বত্ত্ব সমস্যা এবং চিনের জেন্ট্রি বা সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের জমির উপরে আধিপত্য।
প্রাক আধুনিক চিনের ব্যবসা বাণিজ্য ছিল আঞ্চলিক ও শহর কেন্দ্রিক। চিনের ভারী শিল্পের সর্বাধিক বিকাশ সম্ভব হয় নি। তবুও চিনারা কয়লা, লোহা, সীসা, তামা, অ্যান্টিমনি, টিন, সোনা ও রূপোর খনির বিকাশ করেছিল। চিনের প্রদেশগুলিতে স্থানীয় পণ্যাদি বিক্রি হত। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চিনের পোর্সেলিন, তামা, লোহা, চা ও চিনি ছিল প্রধান। চিনা জাহাজ জাঙ্ক দ্বারা চিনারা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য চালাতো। চিনের সূতীবস্ত্রের উৎপাদনও ছিল উল্লেখযোগ্য।
প্রাক আধুনিক চিনের অর্থনীতি আলোচনা করলে দেখা যায়, সেখানে আধুনিক ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রবণতা গড়ে ওঠে নি। চিন বৈদেশিক পণ্যের জন্য কখনই আগ্রহ দেখায় নি। চিনারা বিশ্বাস করত, তাদের পণ্যের উন্নত গুণমানের জন্যই বিদেশীরা চিনে আসে। চিনকে কখনই বিদেশী পণ্যের উপর নির্ভর করতে হয় নি। বলা যায়, এদিক থেকে প্রাক-আধুনিক চিনের অর্থনীতি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ।
Read Offline -প্রাক আধুনিক চিনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা [PDF] – Download Now
প্রশ্ন : নজরানা প্রথা বা Tribute system কি? এর বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা কর। করে এর অবসান ঘটে?
Question: What is Nazrana Pratha or Tribute system? Discuss its features. Does it end?
উত্তর :
চিনা সম্রাট প্রাচীনকালে যখন সামন্তপ্রভুদের জমি দিতেন, তখন তার বিনিময়ে সামন্তপ্রভুদের এলাকায় উৎপন্ন পণ্যসামগ্রী সম্রাটকে নজরানা পাঠাতে হত। পরবর্তীকালে দুর্বল প্রতিবেশীদের কাছে প্রাধান্যের স্বীকৃতি হিসেবে চিনা সম্রাটকে নানাবিধ উপঢৌকন নজরানা হিসেবে পাঠানো হত। এই প্রথাটি নজরানা প্রথা নামে পরিচিত।
নজরানা প্রথা বা Tribute system এর বৈশিষ্ট্য :
ঝং গুয়ো তত্ত্ব অনুসারে চিন বিশ্বাস করত বর্গাকার পৃথিবীর ঠিক মধ্যভাগে অবস্থিত, যেখানে গোল স্বর্গের ছায়া পড়ে, সেখানেই চিন সাম্রাজ্য অবস্থিত। এই বিশেষ অবস্থানের জন্য অন্য সমস্ত জাতি চিনের অধীনস্থ। চিন তার দুর্বল প্রতিবেশী কোরিয়া, আন্নাম, শ্যাম প্রভৃতি দেশকে নিয়ে গড়ে তুলেছিল ‘জাতি সমূহের পরিবার’। চিন মনে করত, পদমর্যাদায় সে সর্ব্বোচ্চ আর অন্যরা চিনের অধীন। আনুষ্ঠানিক আনুগত্যের বিনিময়ে চিন প্রয়োজনে এই রাষ্ট্রগুলিকে সাহায্য করত। এই আনুগত্যের প্রমাণ হিসেবে তারা চিনা সম্রাটকে যে উপঢৌকন দিত, তার নাম, ছিল নজরানা বা Tribute । আফিম যুদ্ধের আগে ইউরোপীয় বণিকরা নজরানা পদ্ধতি মেনে চলত। পাশ্চাত্য দেশগুলি চিনে ব্যবসা করতে এলে চিনা সম্রাট বছরের একটি বিশেষ দিনে তাদের কাছ থেকে নজরানা গ্রহণ করতেন। চিন মনে করত, তত্ত্বগতভাবে যে কোনো রাষ্ট্র চিনের করদ রাষ্ট্র। তাই নজরানা দেবার সময় তাদের চিনা দরবারে কাউ-টাও প্রথায় নতজানু হয়ে নজরানা দিতে হত।
নজরানার পরিমাণ কত, সময়ের ব্যবধানে পাঠাতে হবে এবং কোন পথ ধরে নজরানা চিনে আসবে—এই সবই নির্ধারিত হত চিনা সম্রাটের দরবারে। ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূত ও বণিকেরা এই অপমানজনক নজরানা পদ্ধতি ও কাউ-টাও প্রথা উচ্ছেদ করার দাবী জানালে চিনা কর্তৃপক্ষ তাদের দাবী অস্বীকার করেন।
ইউরোপীয় বণিকেরা নজরানা প্রথার সক্রিয় বিরোধিতা করেছিল। প্রসঙ্গতঃ চিনে প্রচলিত junk trade ছিল নজরানা প্রথা বর্হিভূত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি এই পদ্ধতিতে চিনে ব্যবসা চালাত। নজরানা প্রথাটি ছিল অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। করদ দেশগুলি, এমনকি চিনা রাজদরবারের কাছেও এটি খুব লাভজনক ছিল না।
নজরানা প্রথা বা Tribute system এর কবে কেন অবসান ঘটে?
পাশ্চাত্য বণিকদের সক্রিয় বিরোধিতা, junk trade এর প্রাধান্য, ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথার ব্যয়বহুলতা প্রভৃতি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে নজরানা প্রথার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। শেষপর্যন্ত ১৮৩৯-৪২ খ্রীঃ প্রথম অহিফেন যুদ্ধে চিন পরাজিত হলে নজরানা প্রথার অবসান ঘটে এবং ‘সন্ধি ব্যবস্থা’র সূত্রপাত ঘটে।
Read Offline নজরানা প্রথা [PDF] – Download Now
প্রশ্ন : ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথা সম্পর্কে টীকা লেখো
অথবা, ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথার বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
Question : Write a note on Canton trade customs
Or, discuss the characteristics of Canton trade customs.
উত্তর :
চিনের সাথে পাশ্চাত্য দেশসমূহের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্যান্টন বন্দর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। 1759 খ্রিঃ থেকে কেবলমাত্র ক্যান্টন বন্দরকেই বিদেশী বণিকদের জন্য চিন উন্মুক্ত করে। ক্যান্টন বন্দরের মাধ্যমে ইংরেজ, ফরাসী, পর্তুগীজ ও ওলন্দাজ প্রভৃতি বণিকেরা বাণিজ্য করত। 1842 খ্রিঃ প্রথম অহিফেন যুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত ক্যান্টন পদ্ধতির মাধ্যমে ইউরোপীয় বণিকদের সাথে চিনের বাণিজ্য চলত।
ক্যান্টন বণিজ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল নিম্নরূপ :-
(১) এই ব্যবসার একদিকে ছিল ব্রিটেন ও অন্যান্য বিদেশী রাষ্ট্র; অন্যদিকে ছিল চিনা বণিকদের সংগঠন ‘কো-হং’।
(২) ক্যান্টন প্রথায় ব্যবসায়ীদের চিনা দরবারে কোনো নজরানা পাঠাতে হত না। তবে তারা সেখানে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারত না।
(৩) ক্যান্টনের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হত ‘হং’ নামক একটি বণিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে যারা ক্যান্টনের শুল্ক কমিশনারের (হোপ্পো) নিয়ন্ত্রনাধীন ছিলেন। হং-রাই আমদানী-রপ্তানীর জন্য অন্য দ্রব্যের তালিকা প্রস্তুত করত।
(৪) ক্যান্টন বাণিজ্য পরিচালনার জন্য চিন সরকার কো-হং নামে একটি বণিক সংস্থা গঠন করে। প্রত্যেক বিদেশী বণিককে একজন চিনা বণিককে জামিনদার হিসাবে রাখতে হত। এই জামিনদারদের মাধ্যমে তারা পণ্য দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় করতে পারত।
(৫) পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে ক্যান্টন বাণিজ্য গড়ে ওঠে নি। চিনা বণিকদের লক্ষ্য ছিল যতদূর সম্ভব শুল্ক আদায় করা। এই লাভের অর্থ সম্রাট না পেলেও ক্যান্টনে নিযুক্ত কর্মচারীরা এর সুফল ভোগ করতেন।
(৬) ক্যান্টন বাণিজ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর একপাক্ষিকতা। যেহেতু ইউরোপীয় বণিকরা চিনা পণ্যদ্রব্য ক্রয় করার জন্য বেশী আগ্রহী ছিল তাই তারা মনে করত তাদের নির্ধারিত দাম, শুল্ক ও শর্ত মেনেই বিদেশী বণিকদের ব্যবসা করতে হবে।
(৭) প্রথম দিকে ক্যান্টন বাণিজ্যের ভারসাম্য ছিল চিনের দিকে। কিন্তু পরবর্তীকালে আফিম ব্যবসা প্রকট হয়ে উঠলে ক্যান্টন বাণিজ্যের ভারসাম্য বিদেশী বিশেষতঃ ইংরেজদের অনুকূলে চলে যায়।
প্রথম দিকে বিদেশী বণিকরা বাধ্য হয়ে ক্যান্টনের বাণিজ্যের শর্তাবলী মেনে চলত। কিন্তু আফিম ব্যবসার সূত্রে তারা ক্যান্টন বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলে এই প্রথার অবসানের জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথম অহিফেন যুদ্ধে চিনের পরাজয়ের পর ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসান ঘটে।