1885 থেকে 1905 সাল পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ভূমিকা কি ছিল | History Notes
১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কার্যাবলির মূল্যায়ন করো।
ভূমিকা:
উনিশ শতকের শেষার্ধে জাতীয়তাবাদের বিকাশের ফলে ভারতবাসীর চিন্তা ও চেতনায় যে জাগরণ শুরু হয় তার চূড়ান্ত পরিণতি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম নামক এক অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীর প্রচেষ্টায় বোম্বাই শহরে প্রথম যে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় তার মধ্য দিয়েই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জন্ম নেয় (১৮৮৫ খ্রি., ২৮ ডিসেম্বর)। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ড. তারাচাঁদ বলেছেন—মধ্যবিত্তশ্রেণির সংগঠন হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেস ভারতবাসীর রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।
উদ্দেশ্য :
বোম্বাইয়ের গোকুলদাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজ হলে অনুষ্ঠিত হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন (১৮৮৫ খ্রি., ২৮-৩০ ডিসেম্বর)। এই অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসের চারটি উদ্দেশ্য ঘোষণা করেন—
- ভারতের বিভিন্ন জায়গায় দেশপ্রেমিক কর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সৌহার্দ্য স্থাপন করা।
- জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও প্রাদেশিক সংকীর্ণতার অবসান ঘটিয়ে ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা।
- ভারতের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমসাময়িক প্রধান জাতীয় সমস্যাগুলি সমাধানের উপায় নির্ধারণ করা।
- ভারতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আগামী বছরের রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা।
প্রস্তাব বা পরিকল্পনা:
জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে মোট নয়টি প্রস্তাব পরিকল্পনা হিসেবে গৃহীত হয়েছিল, এগুলির মধ্যে অন্যতম কয়েকটি ছিল —
- ভারতের প্রশাসনিক অবস্থা পর্যালোচনা করার লক্ষ্যে রাজকীয় – কমিশন নিয়োগ করা।
- ভারত-সচিবের কাউন্সিলের বিলোপ ঘটানো।
- উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও পাঞ্জাবে আইনসভা প্রতিষ্ঠা করা।
- ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রে কার্যনির্বাহক ও বিচার বিভাগকে আলাদা করা।
- সামরিক খাতে খরচ কমানো।
- ভারত ও ইংল্যান্ডে একসঙ্গে আই. সি. এস. পরীক্ষাগ্রহণ ইত্যাদি।
কর্মসূচি :
প্রথম যুগে কংগ্রেসের কর্মসূচি দুটি মূল ভাগে বিভক্ত ছিল—
- সরকারি নীতি ও কার্যাবলির গঠনমূলক সমালোচনা।
- ভারতীয়দের স্বার্থে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক সংস্কারের দাবি। এইসব দাবিগুলির মধ্যে ছিল। সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কার।
১)সাংবিধানিক সংস্কারের দাবি:
উল্লেখযোগ্য সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাবগুলি ছিল—
- আইন পরিষদগুলিতে অধিকসংখ্যক নির্বাচিত ভারতীয় সদস্য গ্রহণ ও আইন পরিষদের ক্ষমতা বৃদ্ধি।
- ইন্ডিয়ান কাউন্সিল নামক উপদেষ্টা পরিষদের বিলোপসাধন।
- ব্রিটিশ কমন্স সভায় ভারতের প্রতিটি প্রদেশ থেকে কমপক্ষে দুজন করে প্রতিনিধি পাঠানোর সুযোগ দান।
- ভারত সচিবের মন্ত্রণা পরিষদে তিনজন ভারতীয়ের অন্তর্ভুক্তি।
- নির্দিষ্ট সংখ্যক ভারতীয় সদস্যদের নিয়ে এক রাজকীয় কমিশন গঠনের মাধ্যমে ভারতীয় শাসনব্যবস্থার অনুসন্ধান।
- সমানুপাতিক হারে নির্বাচিত সদস্যের মাধ্যমে নিখিল ভারতীয় ও প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভাগুলির ক্ষমতা বাড়ানো।
2)অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি:
ব্রিটিশ নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থপূরণের লক্ষ্যে এদেশের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যকে ধ্বংস করতে শুরু করেছিল, যা রক্ষার জন্য কংগ্রেস কিছু অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি পেশ করে—
- ভারতে আধুনিক শিল্পের যথাযথ বিকাশসাধন।
- বিদেশি দ্রব্যের জায়গায় আরও বেশি পরিমাণে স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের প্রচেষ্টা চালানো।
- ভারতের কৃষকদের ওপর নির্ধারিত ভূমি রাজস্বের পরিমাণ হ্রাস করা, জমির মালিকানা স্বত্ব আইনের পরিবর্তন ঘটানো এবং কৃষি ও গ্রামীণ ব্যাংক স্থাপন করা।
- ব্রিটিশ শাসিত ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার ঘটানো এবং রায়তওয়ারি অঞ্চলে রাজস্ব আদায়ের কঠোরতার অবসান ঘটানো।
- আদিবাসী উপজাতি গোষ্ঠীগুলির জন্য জটিল বন সংরক্ষণ আইনকে সরলীকরণ করা।
- আয়কর, লবণ কর, আবগারি শুল্কের হ্রাস ঘটানো।
৩)শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি:
কংগ্রেসের শাসনতান্ত্রিক দাবিগুলি ছিল—
- একই সঙ্গে ভারত ও ইংল্যান্ডে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রহণ,
- সিভিল সার্ভিসে ভারতীয় পরীক্ষার্থীদের জন্য বয়সসীমা ১৯ থেকে বাড়িয়ে ২২ করা ও স্ট্যাটুটারি সিভিল সার্ভিসের অবসান ঘটানো।
- শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ।
- জুরির সাহায্যে বিচার প্রবর্তন।
- ভারতীয়দের অস্ত্রবহনের অধিকারদান।
- ভারতীয়দের সামরিক শিক্ষাদান ও উচ্চ সামরিক পদে নিয়োগ ইত্যাদি।
৪) গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি:
ভারতবাসীর বাক্স্বাধীনতা ও দেশীয় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মতো নাগরিক অধিকারগুলি ফিরে পাওয়ার জন্য কংগ্রেস দাবি জানায় ও আন্দোলন শুরু করে। ব্রিটিশ প্রবর্তিত জুরি আইন, নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন (১৮৭৬ খ্রি.), অস্ত্র আইন (১৮৭৮ খ্রি.), মিউনিসিপ্যাল আইন (১৮৯৯ খ্রি.), বিশ্ববিদ্যালয় আইন (১৯০৪ খ্রি.) প্রভৃতি অগণতান্ত্রিক ও দমনমূলক আইনগুলির প্রত্যাহার বা সংশোধনের দাবি জানায় প্রথম যুগের কংগ্রেস।
সীমাবদ্ধতা:
জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের কর্মসূচি ও দাবিগুলির বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল—
- প্রথমত, নরমপন্থী বা মডারেটদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জাতীয় কংগ্রেসের সংস্কার কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীশ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
- দ্বিতীয়ত, এই সময়কার কংগ্রেসি আন্দোলনের মূল কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল – Patience, Conciliation and Union । এগুলির দ্বারা আর যাইহোক কখনোই দাবি আদায় বা কর্মসূচি রূপায়ণ করা সম্ভব নয়।
- তৃতীয়ত, জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্বের নরমপন্থী নেতাগণ আবেদন-নিবেদন নীতির মাধ্যমে ভারতবাসীর অভাব-অভিযোগগুলি ব্রিটিশের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ যে কখনোই আবেদন- নিবেদন নীতিকে আমল দেবে না এই সত্যকে বুঝতে চাননি সেসময়কার কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দ।
- চতুর্থত, ভারতবাসীর আর্থসামাজিক দুরবস্থার মূল কারণ ছিল ব্রিটিশ শাসন ও শোষণ ; এই সতা নরমপন্থী নেতারা জনগণের সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হন।
- পঞ্চমত, প্রথম যুগে কংগ্রেসি সংগঠনের মূল ত্রুটি ছিল তার দুর্বল সামাজিক ভিত্তি। এ প্রসঙ্গে কেমব্রিজ ঐতিহাসিক অনিল শীল বলেছেন— ‘…Indeed what in 1885 was little more than an experiment’ ।
মূল্যায়ন:
জাতীয় কংগ্রেসের প্রথমপর্বের বিভিন্ন দাবি ও কর্মসূচিগুলির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাদের প্রচেষ্টা পরবর্তীকালের জাতীয় আন্দোলনের ভিত তৈরি করেছিল। নিজেদের কার্যাবলির মূল্যায়ন করতে গিয়ে গোপালকৃষ্ণ গোখলের সচেতন উক্তি ছিল… আমাদের ব্যার্থতার মধ্যেই ভবিষ্যতের মহান সাফল্যের শক্তি লুকিয়ে আছে। সবশেষে বিপানচন্দ্রের ভাষায় বলা যায়—– ১৮৮৫-১৯০৫ হল জাতীয় আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপনের যুগ। আদি জাতীয়তাবাদীরা সে ভিত্তি সযত্নেই স্থাপন করেছিলেন।
তথ্যসুত্রঃ-
১) আধুনিক ভারতের ইতিহাস – বিপান চন্দ্র
২) পলাশী থেকে পার্টিশন – শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়
৩) স্বদেশ সভ্যতা ও বিশ্ব – জীবন মুখোপাধ্যায়
৪) স্বদেশ পরিচয় – জীবন মুখোপাধ্যায়
৫) ইতিহাস শিক্ষক – হাজরা ও দত্ত
৬) স্বদেশ ও বিশ্ব – শান্তনু মিস্ত্রী