শহীদ ক্ষুদিরামের জাগ্রত আত্মা [Khudiram Bose]

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now

 

শহীদ ক্ষুদিরামের জাগ্রত আত্মা

রূপশ্রী কাহালী

“একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি” – এই গানটি শুনলে এখনো আমার চোখে জল আসে। ছোটবেলায় বাবার গলায় শুনেছি এই গান। এখনো অনেকের গলাতে এই গান শুনি। এই সেদিনও এক অনুষ্ঠানে শুনেছিলাম এই গান। কোনও এক পল্লীকবির রচিত এই গান বাংলার শহরে ও গ্রামে এখনো অনেকেরই গলায় শোনা যায়। শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর মৃত্যুর পর রচিত হয়েছিল এই গান। শহীদ ক্ষুদিরামের জীবন দানের এবারে শতবর্ষ। ১৯০৮ সালের ১১ আগষ্ট মেদিনীপুরের ছেলে বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়েছিল মজঃফরপুর জেলে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৯।

ক্ষুদিরামের কিশোর এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট :-

ক্ষুদিরামের জীবন কাহিনী অনেকেই জানেন। ১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর মেদিনীপুর জেলায় হবিবপুরে তাঁর জন্ম। ক্ষুদিরামের জন্মের আগে তাঁর মা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর আরো দুটি ছেলে পরপর মারা যায়। তাই নবজাতককে হারানোর আশঙ্খায় ঈশ্বর বিশ্বাসী লক্ষ্মীপ্রিয়া তিনমুঠো খুদের বিনিময়ে তাঁর বড়মেয়ে অপরূপা দেবীর হাতে নবজাতকের দায়িত্ব তুলে দেয়। খুদের বিনিময়ে দেওয়া হল বলে নবজাতকের নাম হল ক্ষুদিরাম। মাত্র ছয় বৎসর বয়সে তাঁর মা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর জীবনাবসান ঘটে। এর এক বছর পরেই তাঁর বাবা ত্রৈলক্যনাথ বসুর মৃত্যু হয়। ক্ষুদিরামের বড়দিদি অপরূপাদেবী ও জামাইবাবু অমৃতলাল রায়ের আশ্রয়েই তিনি বড় হতে থাকেন। জামাইবাবু সরকারী চাকুরে ছিলেন। তিনি বদলি হয়ে মেদিনীপুর এলেন। ক্ষুদিরামকে মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। সময়টা ১৯০৪ সাল। এই সময়েই ক্ষুদিরামের জীবনের এক পরিবর্তন ঘটে।

  • এই কালপর্বে সারা ভারতবর্ষে সে ভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ১৮৮৫ সালে গঠিত হলেও দেশব্যাপী আন্দোলনের কোনও কর্মসূচী তারা তখনো নেয়নি। গান্ধীজী তখনো দক্ষিণ আফ্রিকায় গণআন্দোলন, সত্যাগ্রহ আন্দোলন প্রভৃতি সংগঠকের ভূমিকায়। বাংলা, পাঞ্চাব, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চলে সমগ্র বিপ্লবী দল সংগঠিত হচ্ছে। গুপ্ত সমিতি তৈরি মারফত তাঁরা তাঁদের কার্যকলাপ সংগঠিত করছে। মেদিনীপুরেও গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, সত্যেন বসু, হেমচন্দ্র কানুনগো প্রমুখ এই উদ্যোক্তা। এঁদের সানিধ্যে এসে ক্ষুদিরাম বসু বিপ্লবী দলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৬।
  • ১৯০৫ সলে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হল। প্রতিবাদী মানসিকতা প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপ নিল। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেন। এর পেছনে থাকল ভগিনী নিবেদিতার সমর্থন। উত্তাল হল বাংলা, বিদেশী পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়া হল। রাজা সুবোধ মল্লিক, মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, তারকনাথ পালিত, ঋষি অরবিন্দর উদ্যোগে বিলাতি বিদ্যালয় বর্জনের কথা উঠল। স্থাপিত হল জাতীয় মহাবিদ্যালয় বা বেঙ্গল ন্যাশানাল কলেজ। সে এক উত্তাল সময়। এই সময়ের ডাকে ক্ষুদিরামও শামিল। ১৯০৬ সালে মেদিনীপুর শহরে অনুষ্ঠিত কৃষি ও শিল্প মেলায় সত্যেন বসুর লেখা সোনার বাংলা” নামে একটি প্রচার পুস্তিকা বিলি করার সময়ে ক্ষুদিরাম পুলিশের নজরে পড়ে। শেষ পর্যন্ত তিনি গ্রেপ্তার হল। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭। কিছুদিন কারাবাসের পর প্রমাণাভাবে তিনি ছাড়া পান ।
  • ইতিমধ্যে ১৯০৭ সাল। বৃটিশ সরকারের নির্দেশে কৃষিকর বৃদ্ধি পেল। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকরা প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করলেন। পাঞ্জাবে লালা লাজপত রায় ও অজিত সিং (ভগৎ সিং এর কাকা) এর উদ্যোগে শুরু হল। কৃষকদের জঙ্গী প্রতিরোধ, লালা লাজপত রায় ও অজিত সিংকে গ্রেপ্তার করে বর্মার মান্দালয় দুর্গে নির্বাসিত করা হল। কলকাতাতেও এর প্রতিবাদ ধ্বনিত হল। ঋষি অরবিন্দ লিখলেনঃ-

    “The time now for specches and fine writings is past” টাউন হলের প্রতিবাদ সভায় দাঁড়িয়ে ভগিনি নিবেদিতা বললেন “No more words words words. Let us have deeds deeds – deeds.”

বাংলার গুপ্ত বিপ্লবী সংস্থাগুলিও সক্রিয় হল। তাঁরা অস্ত্র সংগ্রহের কাজে নামলেন। বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো প্যারিসে গেলেন বোমা তৈরি শেখার জন্য। নিবেদিতার পরামর্শেই তিনি সেখানে গিয়েছেন। আবার কলকাতাতেও বোমা তৈরির পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। বিপ্লবী বারীন ঘোষ, উল্লাস কর দত্ত এর উদ্যোক্তা। নিবেদিতার প্রত্যক্ষ উদ্যোগেই আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্ৰ রায়ের গবেষণাগারে এর উদ্যোগ সফল হল। এই বোমার কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য বিপ্লবীরা গেলেন দেওঘরের দিঘিরিয়া পাহাড়ে। সেখানে এই পরীক্ষা সফল হল। কিন্তু পরীক্ষা করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেলেন বিপ্লবী প্রফুল্ল চক্রবর্তী। ইতিমধ্যে হেমচন্দ্ৰ কানুনগো প্যারিস থেকে বোমা তৈরির কলা কৌশল শিখে এসেছেন। হেমচন্দ্র এবং উল্লাসকর দত্ত মিলে বোমা তৈরির এক প্রকার কারখানা খুললেন। এই বোমা তাঁরা বিভিন্ন অঞ্চলে বিপ্লবীদের হাতে তুলে দিলেন।

বিচারক কিংসফোর্ডের মৃত্যুদণ্ড কেন?

যুগান্তর পত্রিকা তখন বিপ্লবীদের মুখপত্র। ঐ পত্রিকায় ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ‘ভয় ত্যাগ কর’ নামে এক প্রবন্ধ লেখেন। ঐ প্রবন্ধ লেখার জন্য ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের বিরুদ্ধে ১৯০৭ সালের ১৬ জুন এক মামলা রুজু করা হয়। এতে বিচারে তাঁর ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ হয়। ভগিনি নিবেদিতা বহুকষ্টে এই অর্থ সংগ্রহ করে দেন। ইতিমধ্যে ঐ পত্রিকায় ঋষি অরবিন্দের কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে অবশ্য লেখকের নাম ছিল না। ক্ষুব্ধ সরকার পত্রিকার স্বতাধিকারী ও অন্যতম সম্পাদক বিপ্লবী বিপিনচন্দ্র পালকে সাক্ষী হিসেবে ডাকেন। তিনি ঐ প্রবন্ধ লেখকের নাম না বলায় ক্ষুব্ধ বিচারক কিংসফোর্ড বিপ্লবী বিপিনচন্দ্র দুই মাসের কারাদন্ড দেন। এর প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। ক্ষুব্ধ জনতার ওপরে পুলিশের লাঠিচার্জ হয়। এতে আহত হন। ১৪ বছরের বালক সুশীল সেন। তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বিচারক তাঁর শাস্তি ছিল ১৫ ঘা বেত। বেত মারার সময়ে রক্তাক্ত সুশীল “বন্দে মাতরম’ ধ্বনি মুখে উচ্চারণ করে এই আঘাত সহ্য করলেন। সারাদেশ কিংসফোর্ডের উপর ক্ষিপ্ত হল, বিপ্লবী গুপ্তসমিতির গোপন সভায় রাজা সুবোধ মল্লিক, ঋষি অরবিন্দ এবং চারুচন্দ্র দত্ত মিলিত ভাবে অত্যাচারী কিংসফোর্ডের প্রাণদন্ডের আদেশ দিলেন। প্রথমে বই বোমার সাহায্যে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হল। পরেশ মৌলিক নামে এক বিপ্লবী এই চেষ্টা করেন। কিন্তু এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইতিমধ্যে কিংসফোর্ড বদলি হয়ে মান মজঃফরপুর। গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি মজঃফরপুরেই তাকে হত্যার উদ্যোগ নেয়। তাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার দায়িত্ব বর্তায় প্রফুল্ল চাকী এবং ক্ষুদিরাম বসুর ওপরে।

প্রযুদ্ধ চাকী এবং ক্ষুদিরাম পরস্পরের পরিচিত ছিলেন না। ক্ষুদিরাম বসু প্রশ্ন চাকীর কাছে পরিচিত হন হরেন সরকার নামে আর প্রফুল্ল চাকী পরিচিত হন দীনেশ রায় নামে। নেতাদের নির্দেশ এবং অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে ১৯০৮ এর এপ্রিল মাসের ১১ তারিখ তাঁরা এসে মজঃফরপুরে পৌঁছান। সেখানে এসে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কিশোরী মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্মশালায় তাঁরা এসে উঠেন। এখান থেকেই তাঁরা কিংসফোর্ডের গতিবিধি লক্ষ্য করলেন। ৩০ এপ্রিল রাত্রে কিংসফোর্ডের গাড়ী কাছে আসা মাত্রই তাঁরা বোমা নিক্ষেপ করে। কিন্তু ঐ গাড়ীতে কিংসফোর্ড ছিলেন না। ঐ গাড়ীতে মিসেড কেনেডি ও মিস কেনেডি নামে দুই ইংরেজ মহিলা ছিলেন। এটি বিপ্লবীরা জানতেন না। বোমায় এই দুই ইংরেজ মহিলা মারা যান। বোমা নিক্ষেপের পরেই ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকী দুজন দুই রাস্তায় পলায়ন করে। সারা রাত পায়ে হেটে মজঃফরপুর থেকে ২৫ মাইল দূরে ওয়াইনি স্টেশনে ক্ষুদিরাম ট্রেন ধরতে আসেন। সেখানেই তিনি গ্রেপ্তার হন। তারিখ ১লা মে ১৯০৮। আর প্রফুল্ল চাকী কে পুলিশ গ্রেপ্তারের চেষ্টা করে মোকামাঘাটে। সেখানে গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য তিনি নিজ রিভালবারের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। তারিখ ২মে ১৯০৮।

ক্ষুদিরামের ফাঁসি

ক্ষুদিরামকে গ্রেপ্তার করে মজঃফরপুরে নিয়ে আসা হয়। সেখানে ২১মে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রজু হয়। ঐ মামলায় ক্ষুদিরাম ছাড়াও আরও দুইজনকে আসামী করা হয়। এঁরা হলেন কিশোরী মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ে অপরজন মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী। মামলা চলাকালীন সময়ে মৃত্যুঞ্জয় মারা যান। কিশোরী মোহনের মামলাকে ক্ষুদিরামের মামলা থেকে পৃথক করা হয়। ক্ষুদিরামের পক্ষে মামলায় উকিল ছিলেন। কালিদাস বসু, উপেন্দ্রনাথ সেন এবং ক্ষেত্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে এঁদের সঙ্গে কলকাতা এবং রংপুর থেকে এসে যোগ হয় কুল কমল সেন, নরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী এবং সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী। এঁরা বিনা পারিশ্রমিকে মামলা পরিচালনা করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ১৩ই জুন ১৯০৮ নিম্ন আদালতে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হল। বিপ্লবী সংস্থার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাইকোর্টে আপিল করা হল ৬ জুলাই। কিন্তু ১৩ জুলাই হাইকোর্ট ফাঁসীর আদেশ বহাল রাখেন। ১৯০৮ সলের ১৩ আগস্ট মজঃফরপুর জেলে তিনি ফাসীর মঞ্চে জীবন দিলেন।

ক্ষুদিরামের অন্তিম যাত্রা নিয়ে ‘বেঙ্গলী’ কাগজে তাঁর উকিল উপেন্দ্রনাথ সেনের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। এতে বলা হয়েছে-

– ভোর ছটায় ফাঁসী হইবে। ভোর পাঁচটায় আমি গাড়ীর মাথায় আবশ্যকীয় সৎকার বস্ত্রাদি লইয়া জেলের ফটকে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম নিকটবর্তী রাস্তা লোকে লোকারণ্য। ফুল লইয়া অনেকে দাঁড়াইয়া আছে। সহজেই আমরা দুইজনে জেলের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দ্বিতীয় লৌহদ্বার উন্মুক্ত হইলে আমরা জেলের আস্তিনায় প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, ডানদিকে একটু দূরে প্রায় ১৬ ফুট উঁচুতে ফাঁসির মঞ্চ। দুইদিকে দুইটি খুঁটি আর একটি মোটা লোহার রড আড় দ্বারা যুক্ত। তারই মধ্যস্থানে বাঁধা মোটা একগাছি দড়ি ঝুলিয়া আছে। তারই শেষ প্রান্তে একটি ফাঁস। একটু অগ্রসর হইতেই দেখিলাম ক্ষুদিরামকে লইয়া আসিতেছে। আমাদের দেখিয়া একটু হাসিল।…… মঞ্চে উপস্থিত হইলে তাহার হাত দুইখানি পিছন দিকে আনিয়া রজ্জুবদ্ধ করা হইল। একটা সবুজ রং এর পাতলা টুপি দিয়া তাহার গ্রীবামূল অবধি ঢাকিয়া দিয়া গলায় ফাঁসী লাগাইয়া দেওয়া হইল। ক্ষুদিরাম সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল এদিক ওদিক একটুও নড়িল না। উডম্যান সাহেব ঘড়ি দেখিয়া রুমাল উড়াইয়া দিলেন। একটি প্রহরী মঞ্চের একপ্রান্তে অবস্থিত একটি হ্যান্ডেল টানিয়া দিল। ক্ষুদিরাম নীচের দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল। কেবল কয়েক সেকেন্ড ধরিয়া ওপরের দড়িটি একটু নড়িতে লাগিল। তারপর সব স্থির।

উদ্বেলিত দেশ

ক্ষুদিরামের মৃত্যু হল। কিন্তু সব স্থির হল না। সারা দেশ উদ্বেল হয়ে উঠল। মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট এবং বাংলা উদ্বেল হয়ে উঠল। প্রতিবাদ করলেন বালগঙ্গাধর তিলক এবং বিভিন্ন প্রদেশের নেতৃবর্গ। জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন সংবাদপত্রে এর প্রতিবাদ ধ্বনিতে হল। কলকাতার প্রেসিডেন্সী, স্কটিশচার্চ কলেজ প্রভৃতি কলেজের ছাত্ররা খালি পায়ে কলেজে এলেন। বিদ্যালয় ছাত্ররা বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকল।

ক্ষুদিরামকে নিয়ে রচিত হল গান – ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’।

আমাদের দেশে ফাঁসীতে জীবন দিয়েছেন অনেকে। বিক্ষিপ্ত ভাবে বিদ্রোহ হয়েছে অনেকবার। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিদ্রোহ হয়েছে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ (১৭৬২-৭৪), মালাবার আন্দোলন (১৭৯২), সাঁওতাল ও মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬, ১৮৯৯-১৯০৫), সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭), ওয়াহরী আন্দোলন (১৮৬৩-৭১)। এই সমস্ত বিদ্রোহের নায়কদের বৃটিশরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। রাস্তার পাশে গাছে ফাঁসীতে লটকে হত্যা করেছে। ইতিহাস এই সমস্ত স্বাক্ষ্য দেয়। ওয়াহাবী আন্দোলনের শের আলীকে আন্দামানে প্রেরণ করা হয়েছিল। ১৮৭২ সালে এই পাঠান বন্দী শেরআলী ভারতের ভাইসরয় লর্ড মেয়োকে আন্দামানে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছিলেন। পরে শেরআলীকে সেখানেই ফাঁসী দেওয়া হয়। সেটা ছিল ১৮৭২ সাল। কিন্তু এই সমস্ত বিদ্রোহ কিন্তু সমগ্র ভারতকে উদ্বেল করেনি। জাতীয় আন্দোলনকে তেমন ভাবে সংহত করেনি। ক্ষুদিরামের জীবন দান সমগ্র দেশকেই উদ্বেল করেছিল। তরুণ সমাজকে উদ্বেলিত হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯০৮ সালের পর জাতীয় আন্দোলনের বিস্তীতি ঘটে। সহিংস ও অহিংস দুই পথেই স্বাধীনতা সংগ্রাম অগ্রসর হয়। ১৯২০এ ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রথম দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯২০ এই শ্রমিকদের সর্বভারতীয় সংগঠন এ আই টি ইউ সি গঠিত হয়। অহিংস কিংবা সহিংস যে ভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রাম অগ্রসর হোক না কেন – ক্ষুদিরাম তাদের প্রেরণা হিসাবে দেখা দেয়। মহারাষ্ট্রে আপ্তে ভাইয়েরা জীবন দেন। বাংলার সত্যেন বসু, কানাইলাল দত্ত, প্রদ্যোৎ ভট্টাচাৰ্য্য, বিনয়-বাদল-দীনেশ গুপ্ত প্রমুখেরা জীবন দেন।

এক মেদিনীপুর শহরেই পরপর তিনজন অত্যাচারী বৃটিশ জেলাশাসক খুন হয়েছিল বিপ্লবীদের হাতে। এরা হলেন রবার্ট ডগলাস, জেমস পেতি এবং বি.ই.জে বার্জ। এক মেদিনীপুর শহরেই ক্ষুদিরাম বাদে আটজন শহীদের মূর্তি রয়েছে। এঁরা হলেন ক্ষুদিরাম, সত্যেন, দীনেশ, প্রদ্যোৎ, অনাথ, ব্রজ, মৃগাঙ্ক, রামকৃষ্ণ ও নির্মল জীবন। যাঁরা অগ্নীযুগের বিপ্লবী। শুধু মেদিনীপুরেই নয় সারা দেশেই বিপ্লবীরা অকুতো ভয় হয়ে কাজ করেছেন জীবনও দিয়েছেন। জীবন দিয়েছেন পাঞ্জাবের শহীদ ভগৎ সিং ও তাঁর সহকর্মীরা। কলকাতায় জীবন দিয়েছেন বিনয়-বাদল-দীনেশ। চট্টগ্রামে জীবন দিয়েছেন মাষ্টারদা সূর্য সেন। জীবন দিয়েছেন শহীদ আসফাক উল্লা । আন্দামানে বন্দী স্বাধীনতা সংগ্রামী ৮৯ দিন অনশন করে জীবন দিয়েছিলেন গদর পার্টির কর্মী পাঞ্জাবের রামরক্ষা। লাহোর জেলে অনশন করে জীবন দিয়েছিলেন বিপ্লবী যতীন দাশ, মেদিনীপুরের মাতা মাতঙ্গিনী অহিংস আন্দোলনেই যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন। ক্ষুদিরামের জীবন থেকে প্রেরণা নিয়েছেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। স-হিংস কিংবা অহিংস আন্দোলনে যারাই যোগ দিয়েছেন, আদর্শে স্থির, ত্যাগ এবং সহিষ্ণুতার জন্য তারা তরুণ ক্ষুদিরামের জীবন থেকেই প্রেরণা পেয়েছেন। ক্ষুদিরামের মৃত্যু হয়েছে একশত বছর, এখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শহীদ ক্ষুদিরামের জাগ্রত আত্মা আমাদের প্রেরণা।

 Reference: 

  1. -রূপশ্রী কাহালী. (2008, September 28). শহীদ ক্ষুদিরামের জাগ্রত আত্মা. Natun Path Eai Samay, Sharatkalin Bisesh Songkha(28th Sep. 2008), 291–293.

[New] ক্ষুদিরাম বসু pdf

[New] ক্ষুদিরাম বসুর আত্মজীবনী |

[New] ক্ষুদিরাম বসু রচনা

[New] ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি কোথায় হয়েছিল

[New] ক্ষুদিরাম বসু স্মরণীয় কেন

ক্ষুদিরাম বসুর গান

ক্ষুদিরাম বসুর মৃত্যু দিন

ক্ষুদিরাম বসুর বাণী





Leave a Reply